প্রবন্ধ

রুমকি আনোয়ারের প্রবন্ধ- নজরুল সাহিত্য এবং নারী

রুমকি আনোয়ারের প্রবন্ধ
নজরুল সাহিত্য এবং নারী


আমি আমার এক প্রবন্ধে লিখেছিলাম কবিরা ঈশ্বরের আশীর্বাদপুষ্ট হয়ে নয় ,অভিশাপ নিয়ে জন্মেছে- নয় শেলি ,কিটস ,বায়রন চলে যায় অকালে, কেন অপঘাতে মৃত্যু হয় রূপসী বাংলার কবি জীবনানন্দের কেনই বা সুকান্ত ক্ষয়রোগে ধুকে ধুকে ক্ষয়ে যায়। নজরুল কেন মূক আর বধির হয়। আজ নজরুল সম্পর্কে লিখতে গিয়ে তাই যেন ফেরৎ আসে। প্রেমের কবি নজরুল

তোমারে পড়িছে মনে
আজি নীপ-বালিকার ভীরু-শিহরণে,

যুথিকার অশ্রুসিক্ত ছলছল মুখে
কেতকী-বধূর অবগুন্ঠিত ও বুকে

সাম্যের কবি নজরুল

গাহি সাম্যের গান-
যেখানে আসিয়া এক হয়ে গেছে সব বাধা-ব্যবধান
যেখানে মিশছে হিন্দু-বৌদ্ধ-মুস্‌লিম-ক্রীশ্চান।
গাহি সাম্যের গান!

অগ্নি – স্ফুলিঙ্গের কবি নজরুল

মহা-বিদ্রোহী রণ-ক্লান্ত
আমি সেই দিন হব শান্ত,
যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দন-রোল, আকাশে বাতাসে ধ্বনিবে না,
অত্যাচারীর খড়গ কৃপাণ ভীম রণ-ভূমে রণিবে না-
বিদ্রোহী রণ-ক্লান্ত
আমি সেই দিন হব শান্ত!

এ সৃষ্টি তখনই হয় যখন প্রেমের কিংবা প্রেম বিরহের সুর হৃদয়ে আঁকা হয় । একটা কিশোরী একটা নারী হয়ে উঠে কবি চেতনার বহ্নিশিখা । নজরুল তা থেকে ব্যতয় ছিল না। কৈশোরে সেই শিউলিমালাকে আমরা সরাসরি তার গল্পে অবলোকন করি।

মূলত মোতাহার হোসেনের কথা ধরেই ”শিউলি মালা” গল্পে আমরা সেই গ্রামের শিউলিকে খুঁজে পাই। বাবা অন্তঃপ্রাণ এই মেয়ে তখন সদ্য ফোটা কিশোরী। নজরুল তার প্রথম প্রেমটা অনেকটাই অব্যক্ত রাখেন। এরপর পরই চলে আসে বুলবুলি নীরব কেন নার্গিস বনে ।

নজরুলের অসম্পুর্ণ এক প্রেমের নাম নার্গিস যার আসল নাম সৈয়দা আসার খানম । ভালোবেসে নজরুল নাম দেন নার্গিস।

এখানে দ্বিমত আছে অনেকেই বলেন বাসরের কথা , আবার অনেকেই বলেন কাবিন সম্পন্ন হবার পূর্বে সম্পর্ক ভেস্তে যাবার কথা কিন্তু জোরের উপরেই বলা যায় যৌবনের ধর্ম মেনে প্রবল প্রতাপে নজরুল ফিরিয়ে দিয়েছিল তাকে। এ সম্পর্কে বিস্তারিত আমরা নজরুলের চিঠিতে পাই –

আর তা থেকে সম্পর্কের যবানিকা যেমন ঘটে এবং তারা যে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিলেন তা প্রতীয়মান হয়।

কবিকে আবদ্ধ করতে নেই বা করা যায় না বলেই বুঝি ঘর জামাই হতে নজরুলের সায় মিলে নি কিন্তু এ সম্পর্ক নজরুলের জীবনে গভীর রেখাপাত করে যায়, তার চিঠির কিছু অংশ এখানে না উল্লেখ করলেই নয়।

”তোমার পত্র পেয়েছি সেদিন নব বর্ষার নবঘন-সিক্ত প্রভাতে। মেঘমেদুর গগনে সেদিন অশান্ত ধারায় বারি ঝরছিল। পনের বছর আগে এমনি এক আষাঢ়ে এমনি এক বারিধারায় প্লাবন নেমেছিল, তা তুমিও হয়তো স্মরণ করতে পারো। আষাঢ়ের নব মেঘপুঞ্জকে আমার নমস্কার। এই মেঘদূত বিরহী যক্ষের বাণী বহন করে নিয়ে গিয়েছিল কালিদাসের যুগে, রেবা নদীর তীরে, মালবিকার দেশে, তার প্রিয়ার কাছে। এই মেঘপুঞ্জের আশীর্বাণী আমার জীবনে এনে দেয় চরম বেদনার সঞ্চার।”

বেদনার সিক্তনীলাম্বরী হয়েও স্পষ্টত দু’জনার মাঝে সম্পর্ক ছিন্নের কথা অমোচনীয় কালিতেই লিখে দেন।

”তোমার যে কল্যাণরূপ আমি আমার কিশোর বয়সে প্রথম দেখেছিলাম, যে রূপকে আমার জীবনের সর্বপ্রথম ভালবাসার অঞ্জলি দিয়েছিলাম, সে রূপ আজো স্বর্গের পারিজাত-মান্দারের মতো চির অম্লান হয়েই আছে আমার বক্ষে। অন্তরের সে আগুন-বাইরের সে ফুলহারকে স্পর্শ করতে পারেনি।

তুমি ভুলে যেওনা আমি কবি, আমি আঘাত করলেও ফুল দিয়ে আঘাত করি। অসুন্দর কুৎসিতের সাধনা আমার নয়। আমার আঘাত বর্বরের কাপুরুষের আঘাতের মতো নিষ্ঠুর নয়। আমার অন্তর্যামী জানেন (তুমি কি জানো বা শুনেছ জানি না) তোমার বিরুদ্ধে আজ আমার কোন অনুযোগ নেই, অভিযোগ নেই, দাবীও নেই।”

নার্গিসের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক মিলনের পূর্ণতা পায়নি। বিয়ের রাত না ফুরাতেই বিদায় নিয়েছিলেন নজরুল। বলে গিয়েছিলেন শ্রাবণ মাসে ফিরবেন। কিন্তু কত কত ‘শাওন আসিল ফিরে সে ফিরে এল না।’

অপূর্ণতার মাঝেও প্রেম থাকে । এ সময় চক্রবাক এবং তার আরও কয়েকটি কবিতায় নার্গিসকে পাই আমরা।

অপূর্ণ প্রেমের ক্ষত মুছতেই প্রেমিক নজরুল চলে আসে প্রমিলার বাহুলগ্না হতে।

এ বিয়ে নিয়ে ঝড় উঠে। উগ্র মুসলমানেরা এতে রবীন্দ্রনাথের গন্ধ শুঁকেন । বস্তুত রবীন্দ্র নাথের সাথে নজরুলের সম্পর্কটা ছিল গুরু শিষ্যের। বলাবাহুল্য হিন্দু সম্প্রদায়ও এ সম্পক্ মেনে নিতে পারে নি । নজরুল চক্ষুশূল হয়ে লিখলেন প্রথমে তার কালজয়ী কবিতা ”বিদ্রোহী আবার একই সাথে মানুষ কবিতাটি।

যারা অজ্ঞ তারাই নিজেদের বিজ্ঞ ভাবে। নজরুলের উভয়সঙ্কটে এবার সরাসরি রবীন্দ্রনাথ এগিয়ে এলেন। ভূয়সী প্রশংসা করে পত্র লিখলেন। এ পত্রটি নজরুলের চলার সুগম করে দেয়। তার এ পত্রটি রক্ষিত আছে বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় জাদুঘরে।

সবাই ভেবে নিলেন এবার কবি বুঝি থিতু হয়ে বসেছেন। থেমে গেছে তার প্রণয় শিখা। সম্পর্ক এগিয়ে গেছে সেভাবেই যেখানে প্রেমের ফল্গুধারা চিরহরিৎ পাতার মতই বিকশিত। বেশ কিছু নাটক এ সময় তিনি লিখে যান। মেহের নিগার, হাস্নাহেনা, ব্যথার দান। নজরুল তখন কালি আর দিস্তার সাথে সম্পর্ক আর রাতে প্রমিলার বাহুলগ্না হয়ে ধ্যানী শালিক।

মেহের নিগার বা হাস্নাহেনাতে আমরা যে নারী চরিত পাই তা একান্তই তার কল্পনাপ্রসূত। ধারণাতে আসে ১৯৩১ সালে উনি চট্টগ্রাম গেলে তার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে অভিভূত হয়েই উনি মেতে উঠেন তার সৃষ্টিতে, হয়ত কোনো উপজাতি নারীকে কল্পিত রূপে এনেছেন এখানে ।

সময় সময়ের হাত ধরে এগিয়ে চলে নজরুল তার পত্রিকা আর লেখা নিয়ে সদা ব্যস্ত।

১৯২৮ সালে মুসলিম সাহিত্য সমাজের দ্বিতীয় বার্ষিক সম্মেলনে অতিথি হিসেবে ঢাকা এসেছিলেন নজরুল। এই সংগঠনের সম্পাদক কাজী মোতাহার হোসেনের বর্ধমান হাউসের বাড়িতে আতিথ্য গ্রহণ করেছিলেন তিনি। এ সময়ে ফজিলাতুন্নেসার সঙ্গে পরিচয় হয় তাঁর। নজরুল হস্তরেখা দেখে ভাগ্য গণনা করতে পারেন শুনে নিজের ‘ভাগ্য ও ভবিষ্যৎ’ জানতে আগ্রহী হয়েছিলেন ফজিলাতুন্নেসা। সোৎসাহে বন্ধু মোতাহারকে নিয়ে তাঁর বাসায় গিয়ে উপস্থিত হয়েছিলেন নজরুল। পরিচয় ও হস্তরেখা বিশ্লেষণ পর্যন্ত ব্যাপারটা ছিল স্বাভাবিক। কিন্তু এর পরের ঘটনাটি রহস্যময়। সেই রহস্যের কিনারা এখনো হয়নি। তবে কাজী মোতাহার হোসেনের স্মৃতিচারণায় এটুকু ইঙ্গিত পাওয়া যায়, এরপর কোনো এক রাতে ফজিলাতুন্নেসার দেওয়ানবাজারের বাড়িতে একা গিয়ে হাজির হয়েছিলেন নজরুল। এই বিদূষী নারীর কাছে প্রেম নিবেদন করেছিলেন। কিন্তু এতকাল যে তরুণীদের সঙ্গে সান্নিধ্যের সুযোগ তাঁর হয়েছিল, ফজিলাতুন্নেসা ছিলেন তার ব্যতিক্রম। অন্য ধাতুতে গড়া এই নারী তাৎক্ষণিক প্রত্যাখ্যান করেছিলেন তাঁকে। প্রত্যাখ্যানের ভাষা ও আচরণ ছিল রীতিমতো কঠোর। এই আঘাত মানসিকভাবে বিপর্যস্ত করেছিল কবিকে।

অসন্মানের জ্বালা ভুলতে পারেন কি করে একজন কবি!

কবিরা যখন লিখে তখন কোন নারীর চোখ সেঁটে থাকে স্বর্ণবিভায় রাঙ্গাতে , আবার না চাইতে নারী আসে। কবিদের সত্তাতেই নারীর পূর্ণতা আসে।

নজরুলের ঢেউ ভাঙ্গা প্রেমের যে শিহরণ স্পর্শ করতে চেয়েছিল শ্যামাঙ্গী এ তরুণীর কি তাচ্ছিল্য করে ফিরিয়ে দেয়া। বেপরোয়া নজরুল এ নিয়ে কাজী মোতাহার হোসেনের কাছে সাতটি আর ফজিলাতুন্নেসার কাছে একটা চিঠি দেন।
ধৃষ্টতা নিয়ে তার উত্তর দেবার প্রয়োজন বোধ করেন নি , নজরুলের লেখা একটা চিঠিতে তা প্রমাণ মিলে ।

বন্ধু মোতাহারকে লেখা চিঠিতে—‘কয় মুহূর্তের দেখা, তারি মাঝে তাঁর কত বিরক্তিভাজন হয়েছি, হয়ত বা কত অপরাধও করে ফেলেছি। পাওয়ার বেভুল আনন্দে কী করেছি না করেছি, কী লিখেছি না লিখেছি তা আমার মনে নেই কোনদিন মনে পড়বেও না।’…তাঁর আঘাত বেদনা অশ্রু আমার শ্বাশতলোকের শূন্য ভাণ্ডার পূর্ণ করে দিয়েছে।’ বসন্ত

ক্ষুব্ধ নজরুল ”কি ছাই করলুম জীবনে কবিতা লিখে, এরচেয়ে অঙ্কের মাষ্টার হলে ঢের ভালো হতো।” এ অসম্পূর্ণ প্রেম নজরুল কে কিছু না দিলেই আমরা পেয়েছি এ সময় অবিস্মরণীয় কিছু কবিতা আর গান ।

ফজিলাতুন্নেসার বসন্ত বাতায়নে মধুকর না হতে পারলেও , আগেপরে অনেক নারীকেই আমরা দেখতে পাই নজরুলের হৃদ-আঙ্গিনাতে । রানু সোম যিনি প্রতিভা বসু নামে সমধিক পরিচিত, নোটন মৈত্র, জাহানারা চৌধুরী অনেকের কথাই উঠে আসে, তবে বাস্তবিক এটাই যে সে প্রেমগুলো পরিপক্কতা পাবার আগেই ঝরে গেছে হয়ত তেমন আচড় কাটতে পারে নি তারা।

পাদটীকাতে এসে বলতে হয় কবিরা সেই ধর্ম লালন করে যেখানে প্রেমের স্বতস্ফুর্ত ঝর্ণা চঞ্চল বেগে প্রবাহিত হয় নজরুল তাকে আগলে ধরতে চেয়েছেন বারবার ।এখনো মনে হয় তার বাঁশি বেজে চলছে আর সব রাধিকা দ্রৌপদী হয়ে পদ্মাসনে । এটাই ডেনসিটি অব লাভ । প্রেমের অনির্বাণ দীপশিখা নিরন্তর জ্বলে প্রেমিক নজরুল। পরিশেষে খুব সহজে একটা কথাই বলি তাঁর সাহিত্যে, নারী প্রেম এতো গভীর, এতো অতলস্পর্শী সে যেন সিন্ধুর মাঝে বিন্দু খোঁজার মতই কিছু ।

 

Related Posts