ছোটগল্প

মোহাম্মদ শহীদুল্লাহর ছোটগল্প- আজকের অতিথি

আজকের অতিথি
মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ


পারুর কাছে কেউ যাচ্ছে না। লকডাউনের মেয়াদ বাড়ছেই। করোনা নামের অদৃশ্য ঘাতক বেশ ভালো আতিথেয়তা পাচ্ছে কারো কারো কাছে। কিন্তু পেটের দায় কি মানে?
শহরের মালঅলা, পাত্তিঅলা, বখরাঅলা, শান্ত সুবোধ, অশান্ত, আমলা…কেউই না। সবাই সামাজিক দুরত্ব মাপে। পাতিলের তলা ঘেঁটে ট্যাপি বোরোর ভাত আর লাল আলুতে শিং মাছের ছালুনের খায়েশটা মরে গেছে। সস্তা একাশিয়ার আধভাঙ্গা ড্রেসিং টেবিলের সামনে এসে ধূলিধূসরিত আয়নাতে মুখটাকে আর ভালো লাগে না। আত্মীয়ের চেয়ে অনেক বেশি বড় আত্মীয় সন্তোষ গ্যালো হপ্তায় দুই কেজি চাল, এক কেজি ডাল রেখে গেছে। এক বক্স প্যান্থার এখনো পড়ে আছে। এখন ত্রিশ এম,এলের প্যারাস্যুট আর মেরিল সাবান কেউ দেয় না। মাথায় সাপের মতো বেণীটা আর বাঁধা হয় না। রাতের গভীরতা বাড়ে। সন্তর্পণে মানুষগুলো বাড়িতে ফেরে, পারুর ছোট্ট চালাঘরের দিকে ভুলেও তাকায় না।
কিন্তু সামাজিক বৈষম্য আর অসম্ভব অস্থির সকাল-বিকাল সব মিলিয়ে এক ধরণের জটলা পাকিয়ে গেছে ।
আজকের খিদেটা বড্ড বেমানান লাগে। গতরাতে পড়শি লায়লার নানী একবাটি পাটশাক দিয়ে গেছে। কিন্তু আজ সারাদিনের অপেক্ষা করতে করতে সূর্যের আলো পশ্চিম দিকে হেলে পড়েছে। অলস গ্যাসম্যাচটার দিকে তাকিয়ে থাকে পারু।

কীরহম আছছ বইন?
বইন ! …হেইলা আবার কোন পিতলা ঘুঘু…পারুর ভ্রু কুঁচকে গেল ।
আগেও দেখেছে। স্কুলের খেলার মাঠে। বেশ সুঠামদেহী। মাথার মাঝখানে একটা সিঁথি। অচেনা। কিন্তু প্রায়শ সামনে পড়তো।
বহুবার তাকে ঘরে আনতে চেয়েছিল পারু। ছেলেটা আসেনি।হয়তো ভীষণ ভদ্রলোক।
আজকেই প্রথম চোখের সামনে। এমনটাই মনে আঁকুপাকু করেছে।
সারাজীবন গেল ঘাসপাতায়। মাংশ ডিমের স্বাদ চেখে নেয়া হয়নি। সবাই সস্তায় খেয়ে গেছে পারুকে। আজ বুঝি সেই সুন্দর বিকেলটা ।
আজকের অতিথিকে নাগালে পেয়ে হাত ধরে টেনে বসায়।বুকের আঁচল দিয়ে টুলটা মুছে পেতে দেয়।মাথার চুলগুলো ছেড়ে দেয়।
উদাস মলিন চোখের নীচে কালশিটে দাগ ।
অতিথি পানি চায়। প্লাস্টিকের জগ থেকে পানি গড়িয়ে পড়ে ম্যালামাইনের মগে। পানি গেলার শব্দটা ঘরের ভেতর ঘাপটি মেরে থাকা নীরবতা ভাঙে।
অতিথি বললো,যাই বইন। দিনকাল ভালা না।
আবারো বইন !
অতিথির হাত ধরেই রাখে। শীর্ণ ঘামে ভেজা, উষ্ণতার আবেশে অতিথির বুকে ঝড় বয়ে যায়।
পারু জিগ্যেস করে…কই গেছিলেন। শইলডা ভালা?
আগে এমন প্রশ্ন কাউকে করেনি পারু। সবাই আসতো। মদ গিলে বুঁদ হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তো পারুর ওপর। যাবার সময় কিছু ময়লা, ছেঁড়া টাকা ছুঁড়ে মারতো।
আজকের অতিথি কী…রকম চুপচাপ ।
থাকতাইন না?
নাহ।
আনহেরে বাইন্ধা থুইয়াম।
মুচকি হাসলো অতিথি। পকেট থেকে একটা হাজার টাকার নোটটা বের করে পারুর কাঁপা কাঁপা হাতে গুঁজে দেয়।
নে…করোনার ঝামেলা চাইরদিগে। বাইরে যাইস না। এই ট্যাকাডা খরচা করিছ।
কিন্তু আমি তো ভিকখা নেই না ।
তোরে তো ভিকখা দেই নাই বইন। তোর এহন বিপদ।কেউ আসে না।
অতিথি দ্রুত বেরিয়ে আসতে চাইছে ।পারু জাপটে ধরে ।
আমি ভিকখা নিমুনা। বিনিময়ে একটা কিছু …আপনে বহেন। ঘরে বিদেশিডা আছে।
ওইসব খাই না। ঠিক আছে । আমার মাথাটা হাতায়া দে।

অতিথি মাথা নোয়ায়।

পারু অতিথির মাথাটা বুকের মাঝে চেপে ধরে।
টপটপ করে গরম জল গড়িয়ে পড়ছে অতিথির মাথায়।
আগে এভাবেই কেঁদেছে পারু। সে সময়ে এই জলের অর্থ ছিল আরেক রকম ।
অত্যাচারের জর্জরিত সিফলিস মার্কা মালঅলা, পাত্তিঅলা, টোকেন অলারা এসে নেকড়ে হয়ে ঢুকতো। পারু চিৎকার করতো…ওরে আল্লারে, আমারে ছাইড়া দে! আমিও তো একটা মানুষ!
আজকের অতিথি বেরিয়ে আসে। পারুর হাতের টাকাটা কপালে বারবার ঘষে ।

Related Posts