ছোটগল্প

মোহাম্মদ হোসেনের ছোটগল্প- প্রেম একটি কালো গোলাপ

প্রেম একটি কালো গোলাপ
মোহাম্মদ হোসেন


মন আছে যার কেয়াবনে,কী করবে তার কেত্তনে। হাসানের মধ্যে নিলা খুঁজে পেয়েছে ওর মন ছবিরই প্রতিচ্ছবি এবং হয়ত তার চেয়েও বেশিকিছু । হাসান হচ্ছে ওর স্বাপ্নিক পুরুষ , যার কথা ভাবলে ও নির্ভার অনুভব করে। তাই তো মিলা যতই বুঝাক, নিলা বুঝে না। মিলা যতই নীতিকথা ঝাড়ুক, নিলা কানে তোলে না। নিলা হাসে, নিলা কাঁদে, নিলা স্বপনেতে বিহার করে, বাউলি প্রান্তরে ঘুরে বেড়ায় একা একা এক আশ্চর্য সুখী মন নিয়ে। ও যেন ভাবনগরে গড়েছে বসতি।
নিলা ও মিলা একই মায়ের গর্ভজাত যদিও, দুইজন দুই স্বভাবে, দুইমুখী। নিলা লাজুক, রোমান্টিক ও একটু ভীতু প্রকৃতির। কিছুটা বোকা বোকা ভাবও খেলা করে ওর চেহারায়। ওর ঠিক উল্টো স্বভাবটাই পেয়েছে মিলা। সে মনে করে , বড় বোনের দুই বছর পর কোন এক শরতে এই জগতে এলেও বিচার-বুদ্ধি, সংসারজ্ঞান ও বাস্তবজ্ঞান তারই বেশি, অন্তত পাঁচ ছয় গুণ বেশি তো বটেই। এই বোধের সওয়ার হয়ে বিভিন্ন কাজে-কর্মে, বিশেষতঃ সংকটময় মুহূর্তে অগ্রজাকে গাইড করাকে তার নৈতিক দায়িত্ব বলে মনে করে সে।
যার সাথে নিলার বিয়ের কথা-বার্তা চলছে এবং শক্তভাবে যার পক্ষ নিয়েছে মিলা, সেই আতিক জামান খান সুপুরুষ বটে। এদেশের মানুষের গড় উচ্চতার চেয়েও ফুটখানেক লম্বা সে। ভরাট স্বাস্থ্যের অধিকারী। পেটা শরীর। জিমে গিয়ে ব্যায়াম করা তার নিত্যদিনের কাজের একটা অংশ। তার প্রশস্ত বুকে হারিয়ে যেতে নিলার কোন সমস্যা হওয়ার কথা নয়। আর ওর জীবনের ভার নিতে প্রস্তুত তার চওড়া দুটো কাঁধ। পেশায় আইনের চর্চাকারী। বেশি দিন হয়নি সে ল’ প্র্যাকটিসে যোগ দিয়েছে। এরই মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে তার যশ-খ্যাতি। পেশার পসার হয়েছে ভাল। চিটাগাং শহরে বাড়ি আছে। দামি গাড়ির মালিক হয়েছে। এখন একজন মনের মত সুন্দরী বউ বগলদাবা করতে পারলেই হবে কেল্লা ফতে।
নিলাকে তো খানের দারুণ পছন্দ হয়েছে। নিলা সুন্দরী ভদ্র নম্র বিনয়ী লাজুক। পোশাকে-আশাকে আধুনিক, অথচ শালীনতাপূর্ণ। এমনটিই তো চাই। তাই তো আট কুঠরি ভরা পুলকে শিহরিত হয়ে আতিক জামান খান খুশিতে তাইরে নাইরে করছে অষ্টপ্রহর। জীবনে কোনদিন কোন মেয়ের সঙ্গ লাভের জন্য সে লালায়িত হয়নি। তবে নিলা এখন তার পয়লা ও একমাত্র ফয়সালা। ওকে পেতে প্রয়োজনে সে জীবন বাজি রাখতে রাজি। তার সওদা বেশ জমে উঠেছে ভবের বাজারে। জমিদার পূর্বপুরুষের রক্ত গায়ে বইছে তো। যা চায় তা পাওয়ার জন্য দর্পভরে পণ করে ধনুর্বাণ হাতে।
আতিক জামান খান আরও খুশি মিলার মত প্রাণবন্ত ও চঞ্চলা হরিণী তার ছোট গিন্নী হবে ভেবে। মিলাও এই অফার ছাড়তে নারাজ। তার মতে, বিত্ত ও চিত্ত মানব জীবনের দুই গুরুত্বপূর্ণ অনুঘটক। ওরা যদি মিতা হয়, জীবনের হয় জয়। কিন্তু বিত্ত বিনা চিত্তে জীবন ক্ষুব্ধ হয়, নয় তো ক্ষ্যাপা।
এ হল মিলার বিশ্বাসপ্রসূত, একেবারে হৃদয়ের তলদেশ থেকে উদগত কথা। তাই তো সে মনকে নয়, ধনকে গুরুত্ব দেয়। বাস্তববাদী মেয়ে সে। আবেগ তারও আছে। তবে ওই আবেগে কখনও জোয়ার আসে না। ফলে সে ভেসে যায় না, তলিয়েও যায় না।
মিলা জানে, হাসান ভাল ছেলে। শুধু ভাল নয়, খুব ভাল। সৎ ও চরিত্রবান। কিন্তু সময় যে বড় খারাপ গো। সংসারও কুরুক্ষেত্র বৈ কিছু নয়। আর জীবন মানে তো খানাখন্দে ভরা দীর্ঘ বন্ধুর পথ। ভটভটিতে চড়ে তো আর এই লম্বা এবড়োথেবড়ো পথ পাড়ি দেয়া যাবে না। দরকার মার্সিডিজ সিডান। কঠিন বাস্তবতার কাঠিন্য দূর করার জন্য চাই টাকা-কড়ির প্রচুরতা, যা হাসানের নেই। সে যা আয় করে তা দিয়ে সংসার নামক রেলগাড়িটা চলবে। তবে তাতে থাকবে না গতি বা বেগ। আর যদি কখনও লাইনচ্যুত হয় কোন কারণে, ওই অবস্থাতেই থাকবে সারাজীবন, ট্র্যাকে আর ফিরে আসবে না।
মিলার দর্শন বলে, বড় হও যদি পার, নইলে বড়র আশ্রয় ধর। সে চায় , নিলাও তার সাথে সুর করে কোরাসে গেয়ে উঠুক একই গান। জীবন সাথী হিসেবে হাসির মালা পরিয়ে দিক আতিক জামান খানকে, কড়ি-আনা-পাই যার কাছে হাতের ময়লা। আর টাকা-পয়সা যার জন্য খনির কয়লা , তাকে সবেগে দূরে ঠেলে দিক নির্দয়ভাবে।
‘আপু, তোমার উচিত ভুলভুলাইয়া চেহারার হাসান মিয়াকে মন থেকে সাঁই করে ফাঁই করে দেওয়া। আর হৃদয়ের খঞ্জনিতে সুর তুলে খানখানান আতিক জামান খানকে রাজাসনে বসিয়ে মাল্যদান করা।’
‘তোরা যা চাস তাই তো হবে। এ যে আমার নিয়তি। আমি তো পাপেট। আমার মন বলে যে কিছু নেই।’ মন খারাপ করে বসে থাকে নিলা। ওর নিজেকে মনে হয় আটলান্টিক মহাসাগরের দূরতম অঞ্চলে অবস্থিত কোন বিচ্ছিন্ন দ্বীপের একমাত্র বাসিন্দা। একা, নিঃসঙ্গ, অসহায়। কোথাও কেউ নেই।
‘ছোটবেলায় তুমি নাকি দেরি করে হাঁটতে শিখেছিলে। গড়গইড়া পিঠা থেরাপি প্রয়োগ করা হয়েছিল যাতে তুমি দ্রুত হাঁটতে শিখ। আমি জানি না, কাঁচা বুদ্ধি পাকাবার এরকম কোন দাওয়াই আছে কিনা। ’
নিলা ক্লান্ত চোখে তাকায় ইঁচড়েপাকা বোনটির দিকে। ও বেশ ক্ষুব্ধ, হতাশ, তিতিবিরক্ত।
‘কখনও খেয়ো না তালে আর ঘোলে, কখনো ভুলো না ঢেমনের বোলে। মন খুব খারাপ জিনিস আপু। মনের ডাকে সবসময় সাড়া দিতে নেই। তাতে পস্তাতে হয়, চোখে সরষে ফুল দেখতে হয়। ফালতো ইমোশান বাদ দিয়ে বাস্তববাদী হও। লাইফ ইজ নট এ্যা রোমান্টিক জার্নি। এখানে ভাবাবেগের কোন মূল্য নেই।’
এ পর্যায়ে এসে মিলা দম নেয় খানিক। তারপর শুরু করে আবার বুলিবর্ষণ, ‘মি. আন্ডারপেইড হাসান মিয়া আর যাই হোক, তোমাকে টাকার সুখ দিতে পারবে না। পারবে ওই খান দ্যা গ্রেট, মি. প্র্যাকটিশনার অব ল’। সত্য-মিথ্যার বোল আউড়ে কেস লড়বে। আর কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা এসে তোমার আঁচলে গড়াগড়ি খাবে, লুটোপুটি খাবে, হাসবে খেলবে, তোমাকে আলিঙ্গন করবে। তখন দেখবে, আহা কী আনন্দ আকাশে বাতাসে, মাতাল হাওয়ার জোয়ার মনের অলিতে গলিতে।’
নিলা জানালা দিয়ে উদাস চোখে চেয়ে থাকে নীল আকাশের দিকে।
‘টাকাতে চোখের সুখ, টাকাতে মনের সুখ। টাকা ছাড়া জীবন চালুনির মত শত ঘুলঘুলিতে ভরা আপু। সেখান দিয়ে পড়ি-মরি করে ভালবাসা পালাবে। তখস সংসার থেকে যে কড়া দুর্গন্ধ বেরুবে, যে নোংরামি আর রূঢ়তা প্রকাশ পাবে,তা তোমার মত নরোম মনের অতি সংবেদনশীল মেয়ে সইতে পারবে না। কদর্যতার ভয়াবহতা দেখে তুমি ভিরমি খাবে। তোমার ভাল চাই বলেই বলছি আপু, রুবী ধরো, রূপা ছাড়ো।’
‘উহ্ অসহ্য!’ বিড়বিড় করে বলে নিলা। ভারি কান্না পায় ওর। অশ্রুরা খেলা করে চোখের গভীরে। ঝাপসা হয়ে আসে দৃষ্টি।
‘ তুমি জান, খান সাহেবকে আব্বু-আম্মুরও খুব পছন্দ হয়েছে। অতএব উপায় নেই। তোমাকে মেনে নিতেই হবে। প্লিজ আপু। আদারওয়াইজ তোমার হবে মরণ- এই আমি বলে দিলাম। ’
চোখে মুখে অন্ধকার দেখে নিলা। প্রিয়তমকে ত্যাগ করতে হবে, ভুলে যেতে হবে ভাবতেই যেন হাতুড়ি এসে আঘাত করে নির্দয়ভাবে বুকের মধ্যেখানে। মোচড় দিয়ে উঠে হৃদয় মন। এক আমাজান কষ্টে নিলা নীল হয়ে যায়। বড্ড অসহায় বোধ করে ও, দাবানলের সম্মুখে যেমন নিরুপায় থাকে বৃক্ষ-লতা-তৃণভূমি সব। শিশিরভেজা ঘাসের মত হয়ে উঠে ওর দুই চোখের পাতা।
‘ কন্যা ল বিয়ার সাজনী সাজ ’ গলায় সুর ভাজে মিলা। আর বলে,‘ আহা, আমার ভাগ্যেও যদি এমন কুমির-বর জুটে, আমি রাজরাণী হয়ে থাকব। প্রতিদিন কচকচে টাকার সুখ নিতে পারব। ইচ্ছে হলে বনখেকোর মত টাকা দিয়ে বালিশ বানিয়ে টাকার বিছানায় ঘুমোতে পারব। মন তখন আপনা থেকেই গেয়ে উঠবে, ছন্দে ছন্দে দুনিয়ানন্দে আমি বনফুল গো।’
পুনর্বার গলায় সুর তুলে মিলা বেরিযে যায়। তার পরপরই প্রবেশ করে বীথি। দেখে, নিলা ফুঁপিয়ে কাঁদছে ছোট্ট দেহে কাঁপন তুলে। তাকে নিবিড়ভাবে ছুঁয়ে যায় প্রাণসখীর রোদনভরা বসন্ত।

পরদিন বীথি হাসানকে চায়ের দাওয়াত দেয় তার বাসায়।
‘ কেমন আছ বল। তোমার বর কেমন আছে? ’ চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বলে হাসান।
‘ ও ভাল আছে। ঢাকা গেছে ব্যবসার কাজে। আর আমি ভাই ভাল নেই। চিন্তায় আছি, টেনশানে আছি। সব আলুনি লাগছে।’
‘কেন কী হয়েছে?’
‘ আমার সখীর যে বিয়ে।’
‘ কার কথা বলছ তুমি?’
‘ কার আবার, নিলার!’
‘ নিলার বিয়ে! বাহ, এ তো খুশির খবর, চিন্তার কী আছে!’
‘ এমনভাবে বলছেন যেন আপনারই বিয়ে। আর চিন্তার কথা বলছেন? নন-রোমান্টিক বঠক্কর পুরুষ যারা আপনার মত, তারা এটা বুঝতে পারবে না।’
‘ কী হয়েছে খুলে বলো তো।’
‘ নিলা মরেছে হাজার মরণে।’
‘ মানে?’
‘ ও জেনে শুনে প্রেমের বিষ করেছে পান।’
‘ কী সর্বনাশ!’
‘ প্রিয়তম ছাড়া আর কারো গলায় ও দেবে না মালা।’
‘ কী হবে তাহলে?’
‘ তাইতো ভাবছি।’ বেশ দুশ্চিন্তাগ্রস্ত দেখায় বীথিকে,‘ খইয়া বাঁধনে পড়ে ও তো বেদিশা। বাবা-মা ওর কাছে জানমান। আর মনের মানুষটি নাই মানে হেমলক পান। বুঝতে পারছে না কী করবে। চিন্তায় চিন্তায় ও আমশি হয়ে গেছে।’
‘ ভাবনার বিষয় বটে।’ চায়ের কাপে শেষ চুমুক দেয় হাসান।
‘ তাজ্জব ব্যাপার কী জানেন?’
‘ কী?’ উৎসুক দৃষ্টি নিয়ে হাসান তাকায় বীথির দিকে।
‘ বোকা মেয়েটি যার জন্য উন্মুখ হয়ে আছে তাকে এখনও এপ্রোচই করেনি।’
‘ যত শীঘ্র তত ভাল। অযথা কালক্ষয় করে কী লাভ।’
‘ ওর ভয়, মনের মানুষটি যদি ওকে ইগনোর করে। লজ্জায় অপমানে ও মরেই যাবে নাকি।’
‘ শোন বীথি, আমি মেয়ে চিনি হাসে, পুরুষ চিনি কাশে। নিলা হচ্ছে নিলা। আর একশজনের মত ও নয়। শুচিরুচি মন ওর, রুচিরা মনন। যেমন রূপ তেমন গুণ। ওকে কেউ হেলা করবে বিশ্বাস করি না।’
‘ কিন্তু কথা হল, এ ব্যাপারে নিলা আধুনিক হয়ে উঠতে পারেনি। পুরোমাত্রায় অবসোলিট এখনও। লজ্জাবতী গাছ তো, লাজে মরি মরি। কী করা যায় বলুন তো।’
হাসান হেসে বলে,‘অন্ধকে বলছ পথ দেখাতে?’
‘ তাই তো বলি, আপনি অরোমান্টিক শুকনো কাঠপুরুষ। রসকষশূন্য পদার্থ নাই জাতীয় কিছু। দুর্ভাগ্য হচ্ছে, নিলার পছন্দের মানুষটিও ঠিক আপনার মত। একেবারে আপনার ফটোকপি, বঠক্কর।’
‘ এ যে দেখছি বিরাট সমস্যা!’
‘ সমস্যা মানে সমস্যা। এক কাজ করবেন?’
‘ বল শুনি।’
‘ অবোধে বুঝাব কত বোধ নাহি মানে, ঢেঁকিরে বুঝাব কত নিত্য ধান ভাণে। নিলাকে অনেক বুঝিয়েছি, কাজ হয়নি। এখন আপনি ওকে একটু বুঝিয়ে বলুন না, ও যেন ওর বাবা-মার সিদ্ধান্ত হাসিমুখে মেনে নেয়।’
‘ পাগল নাকি! ও আমার কথা শুনবে কেন! আর আমিই বা ওকে বুঝাতে যাব কোন অধিকারে! তুমি বড় পাগল আছ হে।’
‘ আপনাকে নিলা খুব পছন্দ করে। আপনি বুঝালে ও ঠিক বুঝবে।’
‘ কী বুদ্ধি তোমার, মুরগীর ভার দিচ্ছ শিয়ালের হাতে!’
‘ জী জনাব,আমার বুদ্ধি লোপ পায়নি, আমি জেনে-শুনেই বলছি।’
‘ তাই?’
‘বোগাসবোর দাঁত আছে, কামড়াতে পারে না। নখ আছে, আঁচড়াতে পারে না। পাখা আছে, উড়তে পারে না। এই শিয়ালও তেমনি। নামে শিয়াল, কিন্তু কাজে ফক্কা। কী, আমার কথা রাখছেন তো ?’
‘ না হে, এ আমার কর্ম নয়।’, হাই দিতে দিতে বলে হাসান।
‘ আপনার কর্ম কী শুনি?’ বেশ ক্ষুব্ধ হয় বীথি।
‘ কী সমস্যা, তুমি রেগে যাচ্ছ কেন!’
‘ রাগছি না, আপনার অসহায়ত্ব দেখে অবাক হচ্ছি। পুরুষ বটে, কিন্তু পৌরুষ নেই। আপনি যে একটা নপুংশক আছেন, আমার জানা হয়ে গেছে। দুইপেয়ে জবরদস্ত ভেড়া একখান।’
রাগে-ক্ষোভে বীথি দৃষ্টি অন্যদিকে সরিয়ে নেয়।
বীথির কথার চাবুকে বেদম মার খেয়ে হাসান ক্ষত-বিক্ষত, হতভম্ব। গনগনে জ্বালার উত্তাপ সে অনুভব করে বুকের এখানে-ওখানে সবখানে। ইচ্ছে হয়, মেয়েটির বেঢপ কথামালার কিছু তেজালো জবাব দেয়। কিন্তু সে হজম করে আঘাত। উত্তেজনাকে জয় করে। আগের মতই স্বাভাবিক কন্ঠে বলে, ‘নিলার ভাল চাই বলেই কি আমি নপুংশক, মিজ বীথি?’
‘ ওর ভাল চাওয়ার আপনি কে?’
‘ তা ঠিক, আমি কে। কিন্তু ও যে আমার কে , কী করে বুঝাই বল।’ আবেগের বেগ সামলাতে বেগ পায় হাসান। ভারী হয়ে আসে তার গলা।
বীথির মুখে হাসি ফুটে উঠে,‘ সরি হাসান ভাই কটু কথা বলেছি বলে। যদি কিছু মনে না করেন, একটু আসবেন?’
‘কোথায় ?’
‘ আপনার মত ন্যাড়াদের গন্তব্য তো বেলতলা বলেই জানি।’
হাসানকে ঝুলবারান্দা পর্যন্ত এগিয়ে দেয় বীথি।
ওখানে নিলাকে দেখে হাসান চমকিত হয়। একই সাথে হয় পুলকিত। তার রোমান্টিক ভাবনা প্রফুল্লচিত্তে নেচে উঠে যখন দেখে তার পছন্দের নীলে ও সেজে এসেছে। তবে তার হৃদয়সত্তা দুঃখ ভারাক্রান্ত হয় ওর ফুলমুখে বিষাদের কালছায়া দেখে। মায়া জড়ানো চোখে অশ্রুর গড়াগড়ি। এ যেন ভরা বসন্তে ভরা বরষা।
‘আমি আপনার কে হই বলুন।’
হাসানের চোখে চোখ রেখে ব্যাকুল হয়ে জানতে চায় নিলা। অভিমানে ওর ঠোঁট দুটো কেঁপে উঠে। চোখের পাতাও কাঁপে থরো থরো।
হাসান বুঝতে পারে, নিলার ডাগর নয়নজোড়ায় খেলা করছে অনেক না বলা কথা, রাশি রাশি অব্যক্ত যন্ত্রণা, আর প্রবল বেগে প্রবহমান এক দরিয়া কান্না।
তার খুব ইচ্ছে হয়, নিলার অশ্রুজলে সিক্ত শ্যামলবরণ চিবুকখানি আলতো করে ছোঁয়। আর বলে, নিলা, তোমার কুঁড়েঘরে আমি বসতি গড়ি, তুমি হও গহীন গাঙ আমি ডুইব্যা মরি।
‘কী হল বলবেন না?’ নিলা পুনর্ব্যক্ত করে ওর দেহ-মন-হৃদয়ের ব্যাকুলতা।
‘তুমি আমার এক কঠিন যন্ত্রণাময় অনুভব।’
‘ওই অনুভব সুখের, তাই কিনা বলুন।’
হাসান মাথা নাড়ে হ্যাঁ-সূচক।
মুখ আলো করে হাসে নিলা। ভোরের আলোর মত রমণীয় ও কমনীয় সেই হাসি। ‘ আমার বেলায়ও এমনটি হয়।’, ও বলে। তবে সেই সুখের ধরণ, প্রকৃতি বা ব্যাপ্তি ও ব্যাখ্যা করতে অক্ষম্। ওর জানা সকল শব্দ, ভাষা, পরিভাষা এখানে মার খায়। মনে হয়, এই সুখ কেবল অনুভবেই উপলব্ধি করা সম্ভব। একে ভাষাবন্দী করা অসম্ভব।
দুইদিন পর হাসানের বাবা-মা বিয়ের আনুষ্ঠানিক প্রস্তাব নিয়ে যায় নিলাদের বাড়ি। তারও দুইদিন পর ওরা দেখা করে সেই একই জায়গায়, বীথিদের ঝুলবারান্দায়।
নিলার ভরদেহে ভর করে আছে রাজ্যের ভয়, উদ্বেগ আর উৎকন্ঠা। ওর চোখের জলের নদী হাসানকে কাছে পাওয়া মাত্র সবেগে প্রবাহিত হয় খরস্রোতা পাহাড়িয়া দরিয়ার মত। ক্ষণে ক্ষণে কেঁপে উঠে দেহখানি। রক্তকরবীর মত টকটকে লাল দেখতে হয়েছে ওর অপার নীল চোখ দুটো। অশ্রুজলে প্লাবিত ফুলমুখ, যেমন করে ভারী বর্ষণের তোড়ে ভেসে যায় মাঠ-ঘাট-প্রকৃতি সব। মুখ-চোখ ফুলে-ফেঁপে উঠেছে চন্দ্রপুলি পিঠার মত।
তবে ঝড়ঝাপ্টা যতই বেয়াড়া হউক, বৃষ্টির তোড়জোড় যতই বাড়াবাড়ি রকমের হউক, একসময় তা থিতু হয়ে আসে। প্রকৃতির নিয়মে নিলাও শান্ত হয় একটানা দুই ঘন্টা আটচল্লিশ মিনিট বত্রিশ সেকেন্ড ভয়াবহ উচ্ছ্বসিত কান্নার পর।
নিলার প্রলয়ংকর কান্নার ভয়ংকর প্রভাবে হাসান স্তব্ধ, বিমূঢ়। বেদম বেদনার সুনামি বয়ে যায় তার সর্বাঙ্গজুড়ে। প্রেমে মগ্ন হয়ে ভগ্ন হৃদয়ে এমন করে কেউ কোনদিন কেঁদেছে কিনা হাসান জানে না। ভয়ানক ভড়কে যায় সে। ওকে সান্ত্বনা দেয়ার ভাষা সে খুঁজে পায় না। বরং এক অজানা আশংকায় কেঁপে কেঁপে উঠে তার সমস্ত সত্তা। না জানি কী হয় যখন নিলা বধূবেশে গাড়িতে চড়ে যাবে খান বাড়িতে একান্ত অনিচ্ছায়।
অস্থিরচিত্ত নিয়ে হাসান ভাবে, পঞ্চবাণে নিলা দগ্ধ হয়েছে। প্রেমের তাপে ও ভাপে ব্যাপক সিদ্ধ হয়েছে। এখন ওর জাউ হওয়ার যোগাড়। তো কী করবে সে এখন ? প্রিয়তমার চোখের জলের ঋণ সে কেমন করে করবে শোধ ?
হাসান দু’দন্ড ভাবে চোখ বন্ধ করে এবং খুব সহজে দ্রুত এমন এক সিদ্ধান্ত নেয় যা একই সাথে কঠিন ও ভয়ংকর, অনাকাংখিত ও অপ্রত্যাশিত।
দুই হাতের অঞ্জলিতে প্রিয়তমার চিবুক উঁচিয়ে ধরে হাসান ওর চোখের অতলান্তিক গভীরে প্রসারিত করে তার দৃষ্টি। গভীর আবেগের সাথে বলে,‘ নিলা, তুমি আমার উচ্চন্ড সুখ, প্রচন্ড বিসুখ। আমি আজ হয়েছি ট্রিস্টান তোমার জন্য।’
পলক না ফেলে রুদ্ধশ্বাসে নিলা বলল,‘ আর আমি ঈসল্ট।’
এই পয়লাবার প্রিয়তমর বহুকাংখিত ছোঁয়া পেল নিলা। তাই বেশ উচ্ছ্বসিত ও, শিহরিত, রোমাঞ্চিত। কাঁপনের ঢেউ খেলে ওর সর্ব অঙ্গে। সাতরঙ্গা পাল তুলে চলে মন পবনের নাও। হৃদয়বীণায় বেজে উঠে তানসেনের সুর।
‘ জানি, ঈসল্ট বেঁচেছিল। কিন্তু . . . ।’ একটু দম নেয় হাসান। নিজেকে প্রস্তুত করে রূঢ় হেসে বলে, ‘কিন্তু তুমি মরবে, হে আমার প্রিয় রক্ত-মাংসের লাল গোলাপ।’
কিছু বুঝে উঠার সুযোগ পায় না নিলা। আচমকা গলা ও গ্রীবায় ফাঁস অনুভব করে ও। কাঁচা হলুদের সৌন্দর্য ওখানটায় নিত্য খেলা করে বেলা অবেলায়। একে হেলা করে হাসানের ইস্পাত-হাতের দশ আংগুল চেপে বসে দৃঢ়ভাবে। এদিকে বাতাসে পতপত করে উড়ছে নিলার নীলবর্ণ শাড়ির আঁচল। সেদিকে একদমই বেখেয়াল হাসান। সে মশগুল আপন কর্মযজ্ঞ সাধনে। বস্তুতঃ এখন সে আর মানবটি নেই, দানবে পরিণত হয়েছে। জগতের সকল সৌন্দর্যের ধারণা এ মুহূর্তে তার বোধেরও অতীত। তার কর্মনিষ্ঠায় হাঁসফাঁস করে নিলা। ওর পার্থিব রঙ্গ-লীলা ভঙ্গ হতে চলেছে কষ্ট আর যন্ত্রণার উন্মত্ততায়। ওর ভীতবিহ্বল চেহারা দেখে খলের মত করুণ হেসে হাসান বলে,‘ মরণের ধরণ দেখে ভয় পেয়ো না মনা। মরণকে স্মরণ করো স্থিরচিত্তে। কেননা ওতেই নিহিত আছে তোমার মুক্তি।’
নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে নিলার, ধীরে ধীরে দম বন্ধ হয়ে আসছে। ডাগর চোখ দুটো আরও ডাগর হয়, শেষ সীমা অবধি প্রসারিত হয়। মুখ হা হয়ে থাকে খুব বিশ্রীভাবে। জিহ্বা পুরোটা বের হয়ে আসবে মনে হচ্ছে। কেমন বিদঘুটে আর কিম্ভূত আকার ধারণ করেছে নিলার সুন্দর মখখানি। এ যেন কোন ভেটকি মাছের মুখ, মানবীর নয়। তবু মায়া দেখায় না হাসান। অথচ এই মুখ দর্শনের জন্য দিনের পর দিন সে অপেক্ষার প্রহর গুণত খুবই ধৈর্যশীল হয়ে। সুযোগ পেলে লুকিয়ে গোপনে চেয়ে থাকত অবাক বিস্ময়ে, অপার মুগ্ধতায়।
প্রিয়তমর দেওয়া বেদনায় নিলা নীল হয়। বাঁচার জন্য ছটফট করে গুলি খাওয়া পাখির মত অস্থিরভাবে। চিৎকার করতে চায়। পারে না। কিছু বলতে চায়। পারে না। মুখ থেকে বের হয় শুধু গোঁ গোঁ আওয়াজ। সে কী আকুতি তাতে বেঁচে থাকার! কিন্তু হাসান তার কর্মসাধনায় অবিচল। যুধিষ্ঠির বটে! নিলার এত আকুতি, এত করুণ চোখের চাহনিতেও সে বিভ্রান্ত হয় না। তার মতিভ্রম ঘটে না। বরং মাথা ঠান্ডা রেখে বাঁকা হেসে বলে,‘ আয়ুষ্মান হও।’ এবং দেহের সব আসুরিক শক্তি চালান করে দেয় দশ আংগুলের শেকর থেকে শিখরে। মেতে উঠে সৃষ্টি নাশের উল্লাসে। তারপর একসময় নিথর হয়ে পড়ে আঠার সাল ধরে তিলতিল করে গড়ে তোলা নিলার লিকলিকে দেহখানি।
নিস্তেজ দেহ নিয়ে এলিয়ে পড়ে নিলা। ওকে পরম মমতায় আঁকড়ে ধরে হাসান। এক্ষণে উথলে উঠে তার প্রেমিক হৃদয় এবং ডুকরে ডুকরে কাঁদে। ‘বোকা মেয়ে, অমন করে কেন ভালবাসতে গেলে?’, বিলাপ করে সে। তারপর ওর নিষ্প্রাণ পান্ডুরবর্ণ ধারণ করা শান্ত সমাহিত মুখের দিকে চেয়ে বিড়বিড় করে হাসান বলে,‘ নিলা, আমার সজনী, আমার বুকের জ্বলুনি, বিদায়। তোমার নয়নভরা জল আমি আমার করে নিলাম। ওপারে তুমি ভাল থেকো, সুখে থেকো।’
নিথর নিস্তব্ধ নিলাকে মেঝেতে যতন করে শুইয়ে দিতে গিয়ে হাসান অনুভব করে, ওর ওজন বেড়ে গেছে অনেকখানি, যেন এক সুমো কুস্তিগীর। সে সামাল দিতে পারে না। নিলা ধপাস করে পড়ে যায় মেঝেতে। ওকে রক্ষা করতে গিয়ে সেও রক্ষা পায় না। ঢলে পড়ে নিলার উপর।
হাসান পালাবে না বলে সিদ্ধান্ত নেয়। না পালিয়ে বাঁচবে সে।
প্রশস্ত বারান্দার ওপাশে গিয়ে দাঁড়ায় হাসান। হাঁফ ছাড়ে আয়েশ করে। মনে হয় যেন এক প্রকান্ড শিলাখন্ড ক্ষিপ্ত হাতির মত দাপিয়ে বেড়াচ্ছিল তার বুকের এপাশ ওপাশ। এখন সে ওটা থেকে মুক্তি পেয়েছে। দুই হাতের মুঠিতে স্টীলের গ্রীল ধরে গভীর আবেশে চেয়ে থাকে সুদুরপানে নীল আকাশের দিকে। নীল আকাশে অতিশয় চমৎকৃত হয় সে। নিলাও হত।
হাসানের সুগভীর তন্ময়তা কাটে যখন সে আপনাকে খুঁজে পায় আলো-বাতাসশূন্য হাজতের বদ্ধ কুঠুরীতে। ওখানে তো আর আকাশের দেখা মেলে না। বুক ভরে নিঃশ্বাস নেয়া যায় না। কারো মিষ্টি হাসিতে সৃষ্টি নাশ হয় না।
আদালতে হাজির করা হয় হাসানকে। প্রতিপক্ষ আইনজীবী আতিক জামান খান ক্রুদ্ধ মন নিয়ে এগিয়ে আসে হাসানের উপর আগুন-কথার গোলা বর্ষণ করবে বলে, জেরার তান্ডব চালিয়ে তাকে লণ্ডভণ্ড, বিপর্যস্ত করে দেবে বলে। তবে সে হতাশ হয়। হাসান স্বেচ্ছায় স্বীকার করে ঘটনার সাথে তার সম্পৃক্ততা পরিবার কর্তৃক নিযুক্ত তার আইনজীবীর বারম্বার নিষেধ সত্ত্বেও। তবে তার বিচক্ষণ আইনজীবী সাহেব বিজ্ঞ আদালতের সম্মুখে প্রমাণ করতে সক্ষম হন যে, তাঁর মক্কেল একজন মানসিক রোগী। তার চিকিৎসার প্রয়োজন।
সত্য বটে, ঘটনার পর থেকে হাসান এক দুই কদম করে এগিয়ে গেছে এলোমেলো জগতের দিকে। এখন তার মনযন্ত্র পুরোপুরি বিকল। সে আজ রিক্ত, সিক্ত, দিকভ্রান্ত।
তবে হাসান মানসিক রোগী হলেও পাগলামি বলতে যা বুঝায় সেরকম বেঢপ আচরণ খুব একটা করত না। অধিকাংশ সময় তাকে দেখা যেত শান্ত, তবে বিমর্ষ। সবসময় কী যেন ভাবত। দুঃখ যখন পাগলা ঘোড়ার গতি নিয়ে ছুটত দুর্নিবার, তখন কান্না করত বেশি বেশি- কখনও নীরবে, কখনও বা মৃদু শব্দ করে। আবার কখনও ফুঁপিয়ে কান্না করত বাচ্চা শিশুর মত। আর গাইত বিরহের গান।
তারপর গত হয়েছে কত শত ঘন্টা মাস দিন। বিস্মৃতির গর্ভে কিছু হয়েছে লীন, কিছু অমলিন। রাজনীতির বিষপাকে পড়ে বুড়িগঙ্গা-গোমতী-কর্ণফুলির পানি ঘোলা হয়েছে অযথা। দেশে ডিজিটাল পিরানহার ভয়ানক উপস্থিতি দৃশ্যমান। তার থেকেও বড় আতংকের ব্যাপার সারমেয় সমাচার। দুইপেয়ে কুকুরদলের প্রলয়নৃত্যে ভয় সর্বত্র-কী হয় কী হয়। কিন্তু এসবের কিছুই হাসানকে স্পর্শ করে না। তার অনুভবে ছুঁয়ে যায় না যে, তার প্রিয় স্বদেশ চলছে নিরুদ্দেশ। সে আপনাকে নিয়ে ব্যস্ত ভীষণ।
একদিন এক সুন্দর বিকেলে ( সুন্দর মানে সুন্দর- অসম্ভব সুন্দর। শেষ বিকেলের নরোম মিষ্টি আলোয় ছেয়ে গিয়েছিল প্রকৃতি ও জনপদের এপাশ ওপাশ চারপাশ। গাছে গাছে সবুজ পাতার আবাহন। কোথাও আবার লাল কৃষ্ণচূড়ার মাদকতা। মৃদুমন্দ সমীরণের রোমাঞ্চকর ছোঁয়ায় জীবনটাকেই মনে হচ্ছিল সরল সমীকরণ। দূর আকাশের বুকে ছিল না কোন মেঘের ভেলা- সাদা কিংবা কালো। ওখানটায় কেবলই নীল আর নীল- প্রগাঢ় ও মায়াবী নীল।) হাসান বসেছিল দেয়ালে হেলান দিয়ে মেঝেতে। উদোম গা। জমি থেকে সদ্য তোলা আলুর মত ময়লা শরীর। জটাধারী উস্কো-খুস্কো চুল। ঘোলাটে চোখ। লোমশ পা দুটো লম্বা করে ছড়ানো। লুঙ্গি উঠে গেছে হাঁটু ছাড়িয়ে আরও উপরে। বাম হাত মেঝেতে ভর দিয়ে রাখা। আর ডান হাত ঘুরপাক খাচ্ছে চওড়া লোমশ বুকের উপরিভাগে। ওই বুকের তলদেশের অবস্থা ভীষণ করুণ, ভয়াবহ খরায় মাঠ-ঘাট, জমি-জমা শুকিয়ে যেমন চৌচির হয়, দীর্ণ-বিদীর্ণ হয় তেমনি। চোখে পানি। মুখে সেই প্রিয় গান যা সে প্রতিদিনই গায়- নিলা, তুমি আবার এসো ফিরে, ভালবাসা কাঁদে বুক চিরে চিরে।
তখনই, হ্যাঁ, ঠিক সেই মুহূর্তে দরজায় নিঃশব্দে এসে দাঁড়ায় নিলা- আগের চেয়েও সুন্দরী, আগের চেয়েও রূপবতী। ওর রূপের আভায় যেন শরমে মুখ লুকোবে বহু মূল্যবান নীলবর্ণ পাথর নীলার দ্যুতি। দেহের জমিন ভরাট হয়েছে চোখে পড়ার মত। কোমলতা মসৃণতা পেলবতা আছে পূর্ববৎ। তবে সব থেকে বড় পরিবর্তন যা মোটা দাগে ধরা পড়ে তা হল, ওর সর্ব অঙ্গে আষ্টে-পৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে ধবধবে সাদা রঙ্গের শাড়ি।
হাসানের গানের সুরে নিলার বক্ষদেশে মাতাল হাওয়া বয়। তাতে সুখ সুখ হয় না। জ্বালা শুরু হয়। কেটে যায় লয়। ঝরে পড়ে আশার কিশলয়।
কিছু বলতে চায় নিলা। পারে না। কথা জড়িয়ে যায়। এককালের ঠাটবাটসম্পন্ন নিপট ভদ্রলোক হাসানের এখনকার বেহাল দশা দেখে আচমকা মাথায় বাজ পড়ার মত শক খায় ও। প্রাণে সইতে পারে না। কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে দুই হাতে মুখ ঢেকে। কান্তিময় গন্ডদেশ বেয়ে গড়িয়ে পড়ে অশ্রুজল। ওর কান্না যেন শেষ হওয়ার নয়। ওর দুঃখ জলের নদী বহে নিরবধি।
আচম্বিতে নিলার মনে হয়, ওর একান্ত নিকটবর্তী হয়ে কেউ যেন দাঁড়িয়ে আছে গায়ে প্রায় গা ঘেঁষে।‘ কেমন আছ নিলা?’ বলে যেন জানতে চায় কুশল, আর অট্টরোলে বেঢপ হেসে সুখ নেয়। তৎক্ষণাৎ ওর মনে পড়ে বীথিদের ঝুলবারান্দায় সংঘটিত সেই ভয়ংকর দৃশ্য। অন্তরাত্মা শুকিয়ে আসে ভয়ে।
নিলা মূর্ছা যায়।

সিনিয়র অফিসার
প্রাইম ব্যাংক লিমিটেড
কক্সবাজার শাখা

Related Posts