কবিতা

কিরণ আহমেদের একগুচ্ছ কবিতা

পিছু ডাক
কিরণ আহমেদ


র‌ক্তিমাভা এখ‌নও ম্রিয়মাণ সন্ধ্যাল‌গ্নের ঈষৎ আঁধা‌রে যায়নি হা‌রিয়ে ।
অথচ পা‌খিরা ফিরছে নীড়ে
কীসের প্রত্যাশায়, বলতে পারো?
প্রশা‌ন্তি অপার?
ভা‌লোবাসা?
‌মোহ?
দা‌য়িত্ব?
না‌কি, নিতান্তই অভ্যাসের বশে!

জানো, প্র‌তি সন্ধ্যায় আ‌মিও ঘরে ফি‌রি
হন্যে হয়ে উষ্ণতা খুঁজি ভেতরে-বা‌হিরে।

আ‌মিও সুবোধ বালক, মেনে চ‌লি জীবনের পাঠ
তৃষ্ণায় কাতর হই, উপুড় হয়ে শুতে জা‌নি নুয়ে পড়া ঘাসের মতো
আ‌মিও কষ্টে কাতর হই শাবকহারা হ‌রিণীর মতো
আ‌মিও ফসলের মতো অ‌তিজলে হাবুডুবু খাই।
আ‌মিও ক্ষি‌ধের জ্বালায় গোগ্রাসে গিল‌তে জা‌নি ক্ষুধার্থ সতীশের মতো।
অথচ অন্যদের ম‌তো প্রশা‌ন্তির ঘুম, কেন আমি দি‌তে পা‌রি না?

দ‌খিনা বাতাস আজও শিহ‌রিত করে গোমতীর তীরে
সলাজ জলের ঢেউও আমা‌কে ভাসায়-ডুবায় ঠুনকো কাগজের দলার ম‌তো।
মাঝে মাঝে আমি, কিছু পত‌নের শ‌ব্দে চমকে ও‌ঠি আর আমার হাত চলে যায় কাঁ‌ধে
না, সেখা‌নে আজ কা‌রো ছোঁয়া নেই! নেই ক্ষ‌ণিকের জন্যে রক্ত‌চো‌খে ভষ্মকরা কেউ।
দ্রুত নিজের ভুল বুঝতে পেরে ’সরি’ও আর শুনা হয় না।

অথচ আজও যেন পিছু ডাকের প্রতীক্ষা আমাকে দিশেহারা করে।

আজও আমি সচকিত খরগোশের মতো কান খাড়া করে বসে থাকি
বিক্ষুদ্ধ প্রত্যাশারা ভিতরে তড়পায়, হাপিত্যেশ করে
রাতের জোছনায় বিচলিত হই, থাক না ঢেকে পৃথিবীটা অন্ধকারে!
মনের কারাগারে স্বপ্নারা আজও খাবি খায় পথহারা পথিকের মতো।
বলতে পারো, কীসের এতো আকাঙ্ক্ষা?

দিনশেষে সেই ঘরে ফেরা
সবাই যেমন ফিরে …!


অন্তর্লীন


সাদা বকেরা চুপসে যাওয়া ক্ষেতের জলে
স্বপ্নের অভিসারে একপায়ে দাঁড়িয়ে আছে।
খেয়ালী বাতাসের প্রশ্রয়ে দোল খায় ঘাসের নরম-ডগা౼
সোনালি-রোদ্দুর আনে অকপট সুরম্যজৌলুস।
ভাবনারা দোল খায় তোমার এলোমেলো উঠোনে
বরফরঙা-ওড়না ছুঁয়ে
বেড়ে ওঠা শৈলেন্দ্র-সফেদ-উত্তুঙ্গে, নিবিষ্টমন মুহূ‌র্তে আটকে যায়: অতীতের ক্যানভাসে!
যা চিরশত্তুর কুমোরে পোকার দখলে ছিলো সে‌দিন, একটি মুহূর্ত
আগুনচোখে ভষ্ম করি শত্রুর ভবিষ্যৎ আজও।

ভাবালুতা ছেড়ে দিয়ে নিজেকে অবমুক্ত করে সরোবরের প্রান্তিক কাঁকড়া,
একে একে খোলস ছেড়ে বেরিয়ে আসে ঝিনুক আর প্রগৈতিহাসিক কচ্ছপও
অথচ আমি ভেতরে-বাহিরে শক্তশৃঙ্খলে আবদ্ধ।
বুঝি না শৃঙ্খল আমার ভারে ক্লান্ত না আমি শৃঙ্খলের…!

তবুও সময় যায়, তবুও পথ এগোয়, তবুও স্মৃতিসাগরে অপ্রাপ্তির সাম্পানও ঘুরে উদ্দেশ্যহীন।
শুধু দিগন্তটা ঠিক আগের মতোই গাঁয়ের‌ শে‌ষে দাঁ‌ড়ি‌য়ে থাকা গাছের সাথেই লেপ্টে থাকে।
দূরের উইপোকা চোখের সূড়ঙ্গ দিয়ে বেরোয় সুবিধে মতো
বিকশিত ফুলের ডিবিতে বাসা বাঁধাবে বলে।

একে একে রাতদিন একবিন্দুতে এসে মিশে
পুরোপৃথিবী জমাট বাঁধে চোখের কার্নিশ বেয়ে রোদটেবিলে౼
আর আমিও অন্তর্লীন হই প্রথম স্বপ্নের আনাড়ি ঠোঁটে,
নেশাচ্ছন্ন নিঃশ্বাসে, বারেবারে, প্রতিবারে।


দীপ্ত মরণ


তুমি আমার সুখের আগার সুখ বিলাসী স্বপ্ন-মালা
সুখ-সরোবর ডুব-সাঁতারে পাড়ি দেয়া পানকৌড়ি
বিরান আকাশ গন্ধে আকুল, দুঃখবাদী হাস্নাহেনা
মনের ভেতর ভীষণ জ্বালা শ্যামের বাঁশির দামে কেনা।

তুমি আমার একলা থাকার দিনগুলোতে স্বপ্নসোহাগ
কথার ভেলা বইয়ে দেয়া কবির খাতার এপার-ওপার
বিষের জ্বালা নষ্ট করার খুব বিষময় একটা চুমু
রাত-বিরাতে হারিয়ে-খোঁজা দুখ-বিহারী ইচ্ছে-ব্যামো।

তুমি আমার নীরব রাতের চাঁদ-জোছনার রুপোর চাদর
এলোমেলো নাও বাওয়া ওই ক্ষেপামাঝির দ্রোহের সারি
সূর্যচোখে ভষ্ম করা দাবানলের আগুন-নদী
জ্বলতে যাবো আবার আমি, একটু সুযোগ পাইগো যদি।

তুমি আমার নাম না জানা বন্যফুলের রঙিন-খোয়াব
ফুলে ফুলে চোখ জুড়াবে, পরলে গলায় ভীষণ-জ্বালা
জ্বালার নদী জলের তোড়ে কখনো হয় খুব অচেনা
পলির বুকে ফলায় সোনা তবুও তো দুখ্ মুছে না।

তুমি আমার দিনের আলো, আঁধার রাতের কঠিন ক্ষরণ
আমি যেন শিশির-কণা, তোমার ঊষায় দীপ্ত মরণ।


অন্য পৃ‌থিবী‌তে আ‌ছি


এখা‌নে এক‌টি ছোট্ট ঘর ছি‌লো
ঘ‌রে সু‌খের ফোয়ারা ব‌য়ে যে‌তো
কিন্তু আজ আর সে সুখ কাউ‌কে স্পর্শ ক‌রে না
স্পর্শ ক‌রে না ঘুঘুর কোমল চাহ‌নি

এখা‌নে আজ প‌পির চাষ হয়
ক‌ণ্ঠে মেডুসা‌কে ধারণ ক‌রে সবাই
‌ভা‌লোবাসার ব‌লি হয় অবাধ মৈথু‌নে

এখা‌নে আজ আর সীমানা প্রাচীর নেই
হুহু করে উ‌ড়ে বেড়ায় পূর্বপুরু‌ষের প্রেতাত্মা
না, তারা কিছু বলে না, শুধু সরল চো‌খে দে‌খে

আজ আ‌মি অন্য পৃ‌থিবী‌তে আ‌ছি

 

Related Posts