ডায়মন্ড নেকলেস
মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ
কেন আসছেন? একটু তাড়াতাড়ি বলেন। সময় কম।
বলব। মানে- আসলে কিভাবে যে বলি।
আহ্হা- অত থরোবড়ো করতেসেন কেন? বলে ফেলেন।
মানে দুটো পেঁয়াজ হবে?
পেঁয়াজ?
হ্যাঁ আমার পেঁয়াজ ছাড়া মামলেট খেতে ভাল্লাগেনা তো, তা-ই। বাসায় কিছু ছিলো। শেষ। বাজারে গিয়েছিলাম। তিনশ টাকা কেজি!
ঠিক আছে। সে না হয় হবে। আসলে কী জন্যে এসেছেন বলেন তো। পেঁয়াজ, নাকি অন্য কিছু?
আপনার বাসাটার সামনে বিরাট একটা ময়লার স্তূপ। আসতে যেতে পথচারীসহ সকলের জন্য এটি বিব্রতকর। নাক চেপে আর কত হাঁটা যায়।
ঠিক আছে। পরিষ্কার করে দেব। হোলোতো?
ক-ই, মুন্নি- এদিকে একহালি পেঁয়াজ আন তো।
বাসায় আকিমুল সাহেবের বৌ নেই, পার্লারে গেছে। বল্লেন চা-চু খাওয়াতে পারবেন না।
পেঁয়াজ পাওয়া গেলো। ভেতরে পেঁয়াজ আরো আছে কিনা তা জানার একটা ব্যাকুলতা উকিঝুঁকি দিচ্ছিলো।
গৃহকর্মী নিজ থেকেই তায়েবের কানে কানে বলে দিলো-
দেড়শ বস্তা আছে।
দুইজনে ফুসুর ফাসুর? কানে কানে কী গপসপ?
গৃহকর্মী নিজের জান নিয়ে পালালো।
তায়েব ফিরতে ফিরতে ভাবে- আকিমুলের কপালে কালো দাগটা দেখে যে কেউই সহজভাবে মেনে নেবে যে, সে এসব কাজ করতেই পারে না।
তথ্যের লেজ ধরে- থানা নির্বাহী ম্যাজিষ্ট্রেট এলেন- দলবল সব।
আকিমুল ছাত্রজীবন থেকেই বেশ ট্যালেন্ট।
ম্যাজিস্ট্রেট দলবলসহ ফিরে গেলেন। কারণ আকিমুলের বাসায় কোনো পেঁয়াজ নেই। সব গায়েব। বাজারেও হাহাকার। দোকানদাররা সবাই মধ্যবিত্ত। পেঁয়াজ বের করলে পুলিশ বলে- চল্লিশ টাকা কেজি বেচো, নইলে ষাট হাজার টাকা জরিমানা গোনো।
মোকাম থেকে পঞ্চাশ টাকা কেজি এনে চল্লিশ টাকা কেজি বেঁচতে হবে- কোথায় মিলবে কুলিভাড়া, গাড়ী ভাড়া, হাইওয়ে পুলিশ ভাতা, সিন্ডিকেট ভাড়া, বাজারে বিডার ভাতা, দোকান ভাড়া, কারেন্ট বিল…সভা সমিতি, আকিকা,পুজার চাঁদা তো আছেই।
এক সময় এই অস্থিরতা থেমে গেলো। পেঁয়াজের হাত পা ধরে- বড় হওয়া একটা আশা আকিমুলের। এবার বৌয়ের গলায় ডায়মন্ডের নেকলেসটা দিতেই পারবে। পেঁয়াজ ছাড়াও লবন তেল নিয়েও ভাবে। ওগুলো কি আর বসে থাকে?
জ্বালা যত মাঝখানের মাইনক্যা চিপার মানুষ গুলোর। নি¤œবিত্তেরা ভালো কামাই করে। ওদের কাজের শেষ নেই। ঠেলা চালানো, রুটি বেলা, অটো চালানো- দিন শেষে হাজার টাকা।
নীচের পেশাতে সংকোচ নেই। আর উচ্চবিত্ত, সরকারি আমলাদের কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা। তাই জিনিসপত্রের দাম তাকে বিব্রত করে না। লাজ লজ্জার মাথা খায় মধ্যবিত্তরা। কারণ সে দোকান দিয়ে বসেছে, বা বেসরকারি শিক্ষক, এনজিওতে মধ্যম মানের কর্মচারী- তাকে গুনতে হয়- বাজার সওদা, বিদ্যুৎ, তেল, গ্যাসসহ ছেলে মেয়েদের কোচিং; এসব। হিসেব করে লুডু খেলার মতো ছকে।
লুডুর গুটি ঘুরে ফিরে এক, দুই, তিন…..।
ছক্কা পড়েই না। যাও সিঁড়ি পায়, সামনে হা করে থাকা অজগর।
আকিমুলের কলেজে পড়া বড় ভাই তাকে এনে বসিয়েছেন- বাজারে উঁচু তলায়। কীভাবে ময়দা, চিনি দিয়ে গুড় বানাতে হয়। কী করে কৃত্রিম খাদ্য বানাতে হয়, কখন গোডাউনের স্টক করতে হয়, কখন মালটা ছেড়ে দিতে হয়- তিন সাবজেক্টের ক্রস থাকার পরও সে যেন মহা অর্থনীতিবিদ একজন।
বিয়েতে বড়ভাই বেশ হেলপ করেছেন। মেয়েটার মেধাহীনতার কারণে বিয়ে হচ্ছিলোনা- পয়সাঅলা- রাকিব সাবের কন্যা মেহরীনের দোষ, সে ভাল ছাত্রী নয়। তিন চার বারেও এস.এস.সি-র দরজা পেরুতে পারেনি। তার উপর তার দৈনিক পার্লারের খরচা এলাকায় চাউর হয়ে আছে। কেউ সাহসই পায়না। এবার বয়স বেশি। তাই পাণিপ্রার্থীদের রুচি কম।
আকিমুলকে নগদ বিশ লাখ টাকার মধ্যে রফা করেছিলেন বড়ভাই। তার ওপর দেনদরবার, চাকুরী, জমি কেনাবেচা, টেন্ডার অলাকে পাকড়াও করার মত চৌকষ বিদ্যাগুলো সে বেশ মুখস্ত করে ফেলেছে।
পেঁয়াজ নিয়ে তাই বিরাট স্বপ্ন তার। টেবিলে তাল ঠুকতে ঠুকতে- মনের ভেতরে- উত্তাল সমুদ্রটা ঢেউ এর পর ঢেউ তুলে যায়। সে মনে মনে ভাবে সারা জীবনের কপালে কালো দাগটা বিফলে যাবে না। অনন্ত সুখের আচ্ছাদনের আড়ালে ঢেকে যাবে সব। পেছনে ওর বাবার খুঁড়িয়ে চলা জীবন, ওর মায়ের বিনা চিকিৎসায় মারা যাওয়া, বড় ভাইটাও দুর্ঘটনায় পড়লো চাকুরী হারানোর বেদনায়। এবার সব কিছুর হবে অবসান। বুক সম্প্রসারিত হয় উপশহরের মতো। মাসটা বেশ জোসের সাথেই কাটলো। বৌ খুশি। তিন চার দিন পেঁয়াজের গুদাম বন্ধই রাখলো- প্রশাসকদের ভয়ে। বড় ভাই বললেন- হপ্তাখানেক থাক। পরে দেখবা অফিসার মিয়া টায়ারড। জনগনের দম যাইতে যাইতে আবার ফিরা আসছে। যা দিবা তাই খাচ্ছে।
হপ্তা খানেক পর-
গুদামের দরজা ঠেলে ঢুকলো- আকিমুল।
চোখের সামনে ভাসে বৌকে নিয়ে সিঙ্গাপুর শপিং করছে। ডায়মন্ডের দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে চয়েস করছে। কোন তার বৌয়ের গলায় মানাবে।
বুকের ভেতরে একটা ধাক্কা অনুভব করে পেঁয়াজের বস্তায় পেঁয়াজ নেই। সব চারা গজিয়ে গেছে। আর কতগুলো পঁচতে শুরু করেছে।
পূর্ব মইলাকান্দা, শ্যামগঞ্জ, ময়মনসিংহ