ছোটগল্প

মোহাম্মদ জাহিদ হোসেন’র অণুগল্প- ভালোবাসার সহমরণ

ভালোবাসার সহমরণ
মোহাম্মদ জাহিদ হোসেন


দিনের আলো আস্তে আস্তে মৃদু হয়ে এলো।
প্রবাহমান বাতাস আস্তে আস্তে ভারী হয়ে গেলো।
নিজেদের ছায়া আস্তে আস্তে ঘন হতে লাগলো।
অবাক করা কাণ্ড কোথাও ঝড়ো হাওয়া টের পাওয়া গেলো না। আকাশে কোনো বিদ্যুৎ চমক দেখা গেলো না। চারিপাশে কোনো প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের চিহ্ন মাত্র চোখে পড়লো না।
এইবার তাঁরা উঠে পড়লেন। ওই জায়গা থেকে। কষ্ট করে। একে অন্যের সাহায্যে। অদ্ভুত ভাবে পরস্পরের চোখে চোখ রেখে। তখনই সেখানে টলটল করে উঠলো তাদের একান্ত দুঃখের কিংবা আনন্দের মুক্তোবিন্দু।
ওঁরা কি হাসলেন? না বেদনার্ত হলেন? সেই দিনান্তের আলোয়?
আমরা কি কখনো জানতে পারবো সে কথা?
আমরা শুধু জানি যে তাঁরা এক প্রাচীন দম্পতি। জীবনের দীর্ঘপথ হেঁটেছেন ওঁরা একসাথে, সুখেদুঃখে বিজড়িত হয়ে। এইভাবেই হাঁটতে হাঁটতে ওঁরা হঠাৎ করে এসে পড়েছেন এই আশ্চর্য জায়গাটিতে।
—’কি আশ্চর্য জায়গা! এ কোথায় নিয়ে এলে বলো তো?’
— ‘তোমার পছন্দ হয়েছে?
— ‘এতো সুন্দর জায়গা আমি খুব কমই দেখেছি — এতো শান্ত — যেন মনে হয় ছবির মতো আঁকা–‘
—’ওই শিমুল গাছটার দিকে মন দিয়ে তাকিয়ে দ্যাখো — একটা অদ্ভুত জিনিস চোখে পড়বে।’
— ‘কি অদ্ভুত জিনিস?’
—’এই দিক থেকে দ্যাখো — গাছটার এই দিকের অংশটা — যেন কারো হাত — আকাশের দিকে বাড়ানো।’—
বিকেলের হলুদ আলো গড়িয়ে পড়ছিলো গাছের চূড়ায়
— মনে হচ্ছিল গাছটা কেমন যেন অদ্ভুতভাবে বেঁকে উঠেছে আকাশের দিকে। ওঁরা মুগ্ধ হয়ে তাকিয়েছিলো দুজনেই। ওঁরা আউটডোর স্টাডির জন্য ঘুরে বেড়াচ্ছিলো যত্রতত্র। ঢাকা থেকে একটা দূরপাল্লার বাসে চড়ে ওরা গিয়েছিলো হিমছুড়ি— তারপর হিমছুড়ি নেমে সেখান থেকে আবার রিক্সায় কিছুটা গিয়ে — সেখান থেকে পায়ে হেঁটে এসে পৌঁছেছিলো এই প্রাকৃতিক দৃশ্যে ঘেরা মহিম পুর গ্রামে। সারা দিন আউটডোর স্টাডি করে ওদের ফিরে যাওয়ার কথা সন্ধ্যের আগে।
ওঁরা অর্থাৎ অভিক আর কবিতা। একসঙ্গে পড়া আর্ট কলেজের বন্ধু। দুজনেরই থার্ড ইয়ার। তিন বছরের বন্ধুত্ব এখন পরস্পরের একান্ত অবলম্বন ।
‘চলো শুরু করি’ — বলতে বলতে আঁকার সাজসরঞ্জাম নিয়ে বসে পড়েছিলো কবিতা। হ্যান্ডমেড পেপারে অতি দ্রুত চারকোলের দাগ পড়ছিলো। অভিক নিজের কাজ ছেড়ে নিশ্চুপে এসে দাঁড়িয়েছিলো কবিতার পিছনে।
কিন্তু একটু পরেই কবিতার মনে হয়েছিলো চারপাশের আলোটা হঠাৎ যেন বদলে গেছে। উপরের দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে দেখেছিলো এতক্ষণ যেখানে সোনালী আলো আর মেঘ একাকার হয়ে ছিলো, এখন সেখানে চাপচাপ কালো মেঘের অন্ধকার। অভিকও অবাক। —’যাহ্। সব গণ্ডগোল হয়ে গেলো।’। একটা অদ্ভুত ঠান্ডা আর ভারী বাতাস বয়ে গিয়েছিলো তাদের উপর দিয়ে।
আর তারপরেই ওঁরা দেখতে পেয়েছিলো দূরের গাছগুলোর মাথা কি ভয়ানক ভাবে দুলে উঠছে — আর সেই সাথেই শুরু হয়েছে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি — কিন্তু যতো না বৃষ্টি তার চেয়ে ঢের বেশি ঝোড়ো হাওয়া — আর তার সঙ্গে অনবরত বিদ্যুতের ঝিলিক।
দুর্যোগ ক্রমশ বাড়ছিলো। মাঝে মাঝেই বৃষ্টির প্রবলতায় কিছুই দেখা যাচ্ছিলো না। ঝড়ের তাণ্ডবে ভেঙে পড়ছিলো একটার পর একটা গাছ। বিকট শব্দে বাজ পড়ছিলো খুব কাছেই।
—’চলো পালাই’ — বলেছিলো কবিতা।
—’কোথায়?’ — জিজ্ঞেস করেছিলো অভিক।
—সামনে — যেদিকে হোক — দৌড়ে যতোটা যাওয়া যায়।’ — উত্তর ছিলো কবিতার।
— ‘পাগল হয়েছো? —সঙ্গে সঙ্গেই বলেছিলো অভিক।
— ‘তর্ক কোরো না। এখনো সময় আছে।’— চেঁচিয়ে উঠেছিলো কবিতা।
— ‘না। কোথাও যাবো না আমরা। কোথাও না।’ — এই কথা বলেই অভিক শক্ত করে চেপে ধরে ছিলো কবিতার হাতটা।
— ‘যাবে না?’ — মরীয়া হয়ে প্রশ্ন করেছিলো কবিতা।
—’না’ — অবিচল উত্তর ছিলো অভিকের।
বিপর্যয়ের শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়ে প্রাগৈতিহাসিক জীবের মতো অনড় হয়ে এই কথাগুলো বলেছিলো তারা — ওদের অন্তিম মুহূর্তে — ওই সুন্দর জায়গাটিতে।
—’আমার কেন জানি না খালি মনে হচ্ছে একটা মিথ আর প্রবল ভালোবাসার রিয়েলিটি এখানে যা কিনা ভালোবাসার সহমরনের এক বিরল দৃষ্টান্ত…’
তাই গল্পটি শুরু করেছিলাম অভিক আর কবিতাকে নিয়ে। যা নিছক অনুমানের অলীকবিন্দু থেকে নয়। একটি সত্য ঘটনার আধার ছিলো অবশ্যই। এবং সেই সত্যটি হোলো—
–১৯৮৫ সালে জুলাই মাসে এক প্রবল ঝড় হয়েছিলো। মাত্র কয়েক মিনিটের মধ্যে সেই ঝড়ে বিধ্বস্ত হয়েছিলো দক্ষিণবঙ্গের একটি বিরাট অংশ। নিশ্চিহ্ন হয়েছিলো অসংখ্য চালাঘর। প্রাণহানি হয়েছিলো অসংখ্য লেকের। নিহতদের তালিকায় ওরাও ছিলো। ওরা অর্থাৎ অভিক আর কবিতা।

এটি কোনো অনুমান নয়। নিষ্ঠুর সত্য।
অতএব এই মৃত যুগল নিয়ে তৈরি হোলো এক গল্পের সহজ রসায়ন। “ভালোবাসার টান দ্যাখো কিভাবে মৃত্তূ্ হার মানলো ভালোবাসার কাছে। তাইতো অভিক অার কবিতার ভালোবার এ সহমরন বার বার ফিরে আসবে মানুষের মুখে মুখে….
কোন এক সময় জায়গাটিকে ঘিরে দেওয়া হয়েছে লোহার দেওয়ালে, লাগানো হয়েছে একটি পাথরের স্মৃতি ফলক।
কিন্তু সময়ের সাথে সাথে সব গল্পের রঙই ফিকে হয়ে আসে। শ্যাওলা জমে পড়ে থাকা সাদা পাথরের বেদীর পাশে। অস্পষ্ট হয়ে যায় অযত্নের স্মৃতিফলকের অক্ষর।

তাই এখন এই জায়গাটিতে দেখা যায় একটি ভাঙাচোরা জং ধরা লোহার বেড়া। তার ভিতরে আগাছায় ভরা পাথরের বেদী। ফাটলধরা ফলক। যার উপরের কিছুটা অস্পষ্ট অক্ষর গুলির উপর এসে পড়েছে দিনান্তের আলো। যাকে চেষ্টা করলে এখনও পড়তে পারা যায় —

“দাঁড়াও পথিকবর, এক আশ্চর্য যুগলের স্মৃতিতে নির্মিত এই বেদীর সামনে। তোমার ব্যস্ত সময়ের কয়েকটি মুহূর্ত দান করো। ভালোবাসাকে শ্রাদ্ধা করো।”

লেখার তারিখঃ ২৪-০৯-২০১৮

 

Related Posts