গবেষণামূলক প্রবন্ধ প্রবন্ধ

ড.এস এ মুতাকাব্বির মাসুদের কবিতা- উত্তর তিরিশের কবি : শামসুর রাহমান

উত্তর তিরিশের কবি : শামসুর রাহমান
ড.এস এ মুতাকাব্বির মাসুদ


উত্তর তিরিশের আধুনিক বাংলা কবিতায় সমর্পিত এক অতুল সত্তা কবি শামসুর রাহমান
(১৯২৯-২০০৬) এর আজ দ্বাদশ তম প্রায়াণ দিবস।
শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় ” উত্তর তিরিশের কবি: শামসুর রাহমান” শিরোনামে লেখাটি উপস্থাপন করা হলো।
(বলাযায় শামসুর রাহমানের সে সত্তারই শাশ্বত
উত্তরাধিকার তাঁর প্রতিটি কালজয়ী কবিতা।)

উত্তর তিরিশের আধুনিক বাংলা কবিতায় সমর্পিত এক অতুল সত্তা শামসুর রাহমান (১৯২৯-২০০৬)। বাংলা সাহিত্যের পঞ্চাশের দশকে নগরের বিস্তীর্ণ পথে তাঁর নৈঃশব্দ বিচরণ আধুনিক বাংলা কবিতার উৎকর্ষ ও শিল্পচর্চাকে দীপবর্তিকার মতো নিষ্ঠতায় প্রতিষ্ঠিত করেছে। তাঁর কবিতায় নাগরিক সভ্যতার কোমল-মসৃণ চিত্রের ভেতর বাস্তবতার কঠিন রূপবৈচিত্র্যের সন্ধান মেলে।কবিতার নরম শরীরে যে শেকড়ের অবয়ব উদ্ভাসিত তা পুরোটাই নগর। মনে করা হয় বোদলেয়ারের(১৮২১-১৮৬৭) নাগরিক চেতনার ভেতর ক্রমাগত উন্মেষিত এবং বিকীর্ণ বিষক্রিয়ার যে বলয়,শামসুর রাহমান সেখানে নিজেকে হারিয়ে পুনরায় আবিষ্কার করেছেন। আধুনিক কবিতার এ পর্যায়ে মেধাবী এবং শৈল্পিক বিচরণে তাঁর কাব্যসত্তার অন্যমাত্রা অনুস্যূত হয়েছে।জীবনানন্দ (১৮৯৯-১৯৫৪) যেখানে কোলাহলমুখর লোকালয় থেকে দূরে মুক্তির স্বাদ খুঁজেছেন, শামসুর রাহমান সেখানে বিচরণ করেছেন শব্দহীন প্রতীতির সাথে এবং নগরের সার্বিক কোলাহল আকণ্ঠ পান করে তারই নির্যাস কবিতায় তুলে এনেছেন নিপুণভাবে।নগরের জীবন বাস্তবতায় পারিপার্শ্বিক জ্বালাময় কষ্ট ও যন্ত্রণার শৈল্পিক চিত্রের বিভাব বিনির্মাণে তিনি ছিলেন একজন বোদ্ধা স্থপতি। নগরবাস্তবতায় সংস্থিত মানুষের
যন্ত্রণাময় জীবনের যে বিষণ্ণ সুর অনুরণিত হতে দেখা যায়, তারই সফল উপস্থাপন শামসুর রাহমানের ‘ প্রথম গান দ্বীতিয় মৃত্যুর আগে(১৯৬০) শীর্ষক কাব্যগ্রন্থ। কবির স্বগত উচ্চারণ :
” দুর্গন্ধের সুতীব্র পীড়নে রাত্রিদিন বিভীষিকা
সমপরিমাণে; ক্রমাগত কেবলই জড়াই পাঁকে। নিঃশ্বাসে নারক ফোঁসে,আমার অধীর
আত্মা সে- ও
গরলের বিন্দু হয়ে ঝরে সারাক্ষণ, “( খাদ )

বস্তুত তিরিশের কবিরা আধুনিক বাংলা কবিতায় বিষয় ও ভাষা বুননের বিশ্লেষণধর্মী নিরীক্ষা চালিয়েছিলেন নতুন আঙ্গিকে।তাঁদের কবিতায় ব্যক্তিসত্তা ও প্রতিবেশের সামগ্রিক চিত্ররূপ তুলে ধরার যে প্রয়াস,তা কাব্যশৈলী নির্মিতির অনিবার্য শর্ত হিসেবে প্রয়োগের চেষ্টা করেছেন।এমন কী সমাজ ও প্রতিবেশ বাস্তবতার অনন্যপূর্ব জীবনচিত্রের যৌক্তিক উপস্থাপন তাঁদের কবিতায় যথাযথ বিনির্ণীত হওয়ার স্পর্ধা ছিল।এ প্রসঙ্গে বুদ্ধদেবের (১৯০৮-১৯৭৪) সমকালীন মন্তব্য ‘ প্রান্তরে কিছু নেই,জানালার পর্দা টেনে দে’র প্রাসঙ্গিকতাই ছিল উত্তর তিরিশের মূল কথা। তিরিশের মেধাবী কবিগোষ্ঠী- জীবনানন্দ দাশ (১৮৯৯-১৯৫৪), সুধীন্দ্রনাথ দত্ত(১৯০১-১৯৬০), অমীয় চক্রবর্তী (১৯০১-১৯৮৬), প্রেমেন্দ্র মিত্র (১৯০৪-১৯৮৮), অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত(১৯০৩-১৯৭৬), বিষ্ণু দে১৯০৯-১৯৮২) প্রমুখ কবিদের তিরিশি চেতনাসমৃদ্ধ উদ্দীপিত বলয় সমকালীন কাব্যসাহিত্যে নবীভূত এক সৃজনশীল ধারার প্রস্তাবনা তৈরি করেছিল। তিরিশের কবিদের সে বলয় ভেঙ্গে পঞ্চাশের দশকে শামসুর রাহমান আধুনিক বাংলা কবিতায় নিজেকে বতিক্রমী ধারায় উপস্থাপন করেন।এরই সাথে সাথে তিনি খুলে দিলেন সকল পথ,ভেঙ্গে দিলেন সংস্কারের দেয়াল; আর কবিতায় মিশে গেলো পৃথিবী, মানুষ,জীবন,সময়- ব্যক্তিসত্তার সাথে। নগর কেন্দ্রিক জীবন বাস্তবতার পাশাপাশি তাঁর লেখায় অসম্ভব প্রত্যয়ে বিজ্ঞাপিত হয় সমকালীন সমাজ- প্রতিবেশ এবং কবির বক্তিগত অভিলাষ – বাসনা। তাঁর কবিতায় উঠে আসে নগর- জনপদের বাস্তব চিত্র। নিষ্ঠার সাথে ‘Impersonal’ চেতনায় তুলে ধরেন বক্তব্য ও ভাষাকে। তাই এ ঋত্বিকের কবিতায় প্রশান্তির বদলে ওঠে আসে বিশশতকের জ্বালাময় দগ্ধ জীবনের পাণ্ডুলিপি।তারই প্রতিচ্ছবি খুঁজে পাই ‘ আত্মজীবনীর খসড়া’ শীর্ষক কবিতায়।

“শহর জেগেছে,দূরে ঘণ্টায় প্রাণের ধ্বনি,
রোগীর শরীরে নামল নিদ্রা হাসপাতালে,
… গলায় রক্ত তুলেও তোমার মুক্তি নেই…
এ- কথা কখনো জানবে না তবু মৃত্যু হবে।’

প্রসঙ্গটি আর দীর্ঘ না করে শেষ করে দিতে চাই।অনেক কিছুই বাদ দিতে হলো।
জীবনানন্দীয় বলয় থেকে বেরিয়ে আধুনিক বাংলা কবিতাকে শামসুর রাহমান নিজস্বতায় প্রতিষ্ঠিত করে কবিতার শৈল্পিক উৎকর্ষকে আলোকধারায় উদ্ভাসিত করেছেন। আধুনিক বাংলা কবিতায় সফল উৎসর্জন তাঁর কাব্য চেতনার মননশীল অনুধ্যানেরই ফসল।তাই বলা যায় পঞ্চাশের দশকে আধুনিক কবিতার উৎকর্ষ বিকাশে স্বাতন্ত্র্যে সমুজ্জ্বল এক সত্তা শামসুর রাহমান।

বস্তুত কবির স্বপ্নময় সুখ- শান্তির আবাসস্থল ঢাকা একটি দুঃস্বপ্নের দলিল মাত্র। তাঁর কবিতায় যে বার্তা উপস্থাপিত হয়েছে তা- হলো মানুষের বিবর্ণ – ক্লান্তনগরের দিকে নিরন্তর যাত্রার প্রবণতা। কবিতায় শামসুর রাহমান নিয়ত খুঁজে ফিরেছেন তাঁর স্মৃতির অতলান্তে হারিয়ে যাওয়া চিরচেনা, চির- উজ্জীবিত স্মৃতির শহর ঢাকাকে।এধারায় তিনি ঢাকাকে নিয়ে লিখেছেন স্মৃতিচারণমূলক গ্রন্থ ” স্মৃতির শহর “। শামসুর রাহমানের কবিতা আমাদেরকে পৌঁছে দিয়েছে নতুন ” বঙ্গ উম্মেষের ” বার্তা। তাঁর কবিতায় পাশ্চাত্য সুর চেতনা ও প্রতিবেশের জীবনচিত্র অনায়াস উদ্ভাসিত।বাঙালির প্রচল ঐতিহ্যে কবি থেমে থাকতে চান নি বলেই এক উদ্দাম উদ্বেলিত চেতনায় একাত্মবোধের তাগিদ অনুভব করেছেন পাশ্চাত্য জীবনচেতনার সাথে। চিন্তায় ও মননে আধুনিক কবি মিশে যেতে চেয়েছেন বারবার প্রতীচ্য ধারায় নিজের প্রতিবেশ-সংস্কৃতিকে সাথে নিয়ে।আবার আমাদের কবি এও ভুলে যান নিজস্বতা ও পারিপার্শ্বিকতাকে।তাই কবি প্রতীচ্য জীবন- সং
স্কৃতিতে মিলতে চেয়েছেন কিন্তু হারিয়ে যেতে চান নি।তাঁর কবিতায় বিদ্যমান ব্যবহৃত শব্দ সার্কাসের ” আহত ক্লাউন”, কিংবা গলির ” অন্ধ বেহালা বাদক” প্রতীচ্য জীবনের প্রতীকী চিত্রায়ন বলে মনে করা হয়।কবি প্রতীচ্য কাব্য স্টাইল এবং শিল্প- সৌন্দর্যকে অন্তরে লালন করেছেন নিজস্বতায়। তাই তাঁর কবিতায় মেধাবী উপস্থাপনে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে ব্রাক, সেজা,দান্তে,(১২৬৫-১৩২১), বোদলেয়ার(১৮২১-১৮৬৮), লোরকা, এলিয়ট (১৮৮৮-১৯৬৫) এর জগত। আর এখানেই কবি শামসুর রাহমান নিজেকে সমর্পিত করেন একজন বিশুদ্ধ নাগরিক কবি হিসেবে। বলাযায় শামসুর রাহমানের সে সত্তারই শাশ্বত উত্তরাধিকার তাঁর প্রতিটি কালজয়ী কবিতা।


(১৭আগস্ট ২০১৮)

Related Posts