যখন যেমন
রুমানা আখতার
জড়তা মোহ ছাপিয়ে আড়মোড়া ভাঙে ভোর । ডেকে যায় পাখি মিষ্টি সুরে – খোল দ্বার খোল ! বাতাসের ফিসফিসে হাসিতে শিহরিত ফুলের দল লাজরাঙা চোখ মেলে বলে ফেলে অজান্তেই – ভালবাসি ! সূর্যের প্রথম আলোয় রাঙা পত্র পল্লবে সাড়া পড়ে যায় । আরেকটা নতুন দিন বয়ে নিয়ে আসে আরেকটা নতুন আশার বার্তা ।
রীমা প্রতিদিনের মত ভোর হবার আগে ওঠে । ভোর হওয়া দেখে আর প্রতিদিনই জীবনটাকে নতুন করে অনুভব করে । জীবনের সবগুল চাওয়া হয়তো পূরণ হয়না , তবু ছোট ছোট পাওয়া গুলোকে পরম মমতায় আগলে রাখতে চায় ও । এই যে নগর জীবনের এত ব্যস্ততা আর দূষণ , তারপরও ভোরের পবিত্রতা সবসময়ই মুছে দেয় আগের সব পাপ । অন্তত রীমার তাই মনে হয় । মেয়ে ঋতু আর স্বামী আবীরকে নিয়ে তেরো বছরের সংসার জীবনে ছোট ছোট সুখ কুড়ানো রীমার দিনগুলো কেটে যায় স্রোতের মত । সারাদিনের ব্যস্ততায় নিজেকে দেওয়ার সময় খু্ব একটা পায়না ও । কেবল ভোরের সময়টা ! আহা এ সময়টা ওর বড্ড নিজের । কারো জন্য না , শুধু নিজের জন্য ভালবাসা নিয়ে ভোর হওয়া দেখে রীমা । নতুন দিনের শুরু সবসময় ওকে নতুন উদ্দ্যম দান করে । এককাপ চা আর একটা টোস্ট , আয়েশ করে শেষ করা হলেও আরো আধঘন্টা টাক অবসর কাটানোর সময় ওর । তারপর অবশ্য নেমে পড়তে হয় জীবন যুদ্ধে ! সকালের নাস্তা রেডি করতে করতে আবীরকে ডেকে দেয় ও । আবীর নিজে উঠে মেয়েকে ওঠায় , রেডি করে । রান্নাঘর থেকে ওদের খুনসূটি শোনে আর তৃপ্তির হাসিতে মুখটা ভরে ওঠে ওর । তবে কপট ধমকও লাগায় মাঝে মধ্যে ! নাস্তা পর্ব শেষ হতে না হতে ছুটা গৃহকর্মির আগমন আরেকদফা সুবাতাস বয়ে আনে । আবীর অফিস চলে যায় আর ফিরোজার কাজ শেষ হতে হতে মেয়েকে স্কুলের জন্য রেডি করিয়ে নিজেও রেডি হয় দোকানে যাবে বলে ।
রীমার একটা ছোটখাট ব্যবসা আছে । হস্তশিল্প ওকে চিরকাল মোহাবিষ্ট করে রেখেছে , আর ঘর সাজাতেও ও খুব ভালবাসে । তাই সেসব ভালবাসার জিনিষ দিয়েই ছোট্ট পরিসরে একটা ব্যবসা চালায় ও । যদিও আর্থিক দিক থেকে হিসেব করলে অনেকেই বলবে ওর এসব করার কোন প্রয়োজন নেই । তবু ওর মনে হয় নিজেকে ধরে রাখতে নিজের একান্ত কোন কাজের বিকল্প নেই । একসময় নিজের ঘর থেকেই টুকটাক ব্যবসা করতে করতে আজ দোকান নিয়ে বসতে পারাটা ওর কাছে বিরাট একটা পাওয়া বলে মনে হয় । আবীর অবশ্য সবসময় ওকে সাপোর্ট করেছে । সংসার আর সন্তান সামলানো সবটাতেই প্রকৃত অর্ধাঙ্গের মত সঙ্গ দিয়েছে সবসময় ।
মেয়েকে স্কুলে পৌঁছে দিয়ে দোকানের ঝাঁপি খোলে রীমা । বাচ্চাদের স্কুলের কাছেই ওর দোকান । স্কুলে গার্জিয়ানরাই ওর বাধা খদ্দের বলতে গেলে । কিছু কিছু ভাবী তো ওর দোকান ছাড়া ঘর সাজানোর জিনিষ অন্য কোথাও থেকে নেবেন না ! অবশ্য ওর দোকানের জিনিষগুলও সেরকমই । ও অনেক সময় নিয়ে এসব পছন্দ করে আনে । কিছু কিছু ওর নিজের ডিজাইন করাও হয় , যেসব অন্য কোথাও পাওয়া যায়না । দেখতে দেখতে মেয়ের ছুটির সময় হয়ে যায় । দোকান তখন সহকারী মেয়ে দুজনের হাতে ছেড়ে রীমাকে ছুটতে হয় স্কুলে । মেয়েকে বাসায় নিয়ে , সকালে করে রেখে যাওয়া রান্না গরম করে মা মেয়ে একসাথে খেয়ে নেয় । ফাঁকে একবার আবীরকে ফোন করে বা আবীরই কাজের চাপ কম থাকলে ওদের খবর নেয় । খাওয়া শেষ হলে সব গুছিয়ে মিনিট দশেক একটু গড়িয়ে নিয়ে আবার চলে যায় দোকানে । ততক্ষনে নাঈমা চলে আসে । সে ওদের নিচতলার ফ্ল্যাটে থাকে , ঋতুকে সঙ্গ দেওয়া আর পড়ানোর জন্য ওকে মাসিক চুক্তিতে রাখা হয়েছে । মেয়েটা অনেক ভাল । ঋতুকে নিজের বোনের মত আদর করে । যতক্ষন রীমা বাসায় না ফেরে ততক্ষন থাকে ঋতুর সাথে নাঈমা ।
রাত আটটা পর্যন্ত দোকান সামলে বাসায় ফেরে রীমা । ফিরলেই মেয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে ওর ওপর । সারাদিন সে স্কুলে কি করল , নাঈমাপুর সাথে কি কি গল্প হল , পড়া হল সব সবিস্তারে বর্ণনা করার পর ওর শান্তি ! মেয়ের সব শুনতে শুনতে রাতের খাওয়ার ব্যবস্থা করে ফেলে রীমা । আবীরের ফিরতে প্রায় দশটা বাজে । সে ফিরলে সবাই মিলে একসাথে খেয়েদেয়ে খানিক টিভি দেখে শুতে যায় । কখনো ওর আবার কখনো আবীরের চাওয়ায় শরীরি প্রেমে ভাসে প্রায়ই । ক্লান্ত তৃপ্তিতে আবার নতুন আরেকটা দিনের শুরুর অপেক্ষায় পুরোনো দিনটাকে ঘুম পাড়ানী গান শোনায় । পরের ভোরটা আবার নতুন গল্প শোনাবে জীবনের ।
বোধহীন রীমাকে দেখে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বিপ্লব । বড্ড সরল ছিল বোনটা ওর ! ছোট্ট ছোট্ট সুখ কুড়িয়ে মালা গাঁথতে গিয়ে মালার সুতোয় ফাঁস তৈরি করে ফেলেছে কখন , টেরই পায়নি বেচারি ! সুন্দর সাজানো বিশ্বাসের সংসারে কখন যে অবিশ্বাসের কীট বাসা করে সব কুড়ে খেয়ে নিয়েছে বুঝতেই পারেনি ! মেয়ের জন্য রাখা গৃহশিক্ষিকা কাম সঙ্গীনি কখন রীমার অজান্তে ওর স্বামীর সঙ্গীনি হয়ে উঠেছিল টেরটাও পায়নি সরল মেয়েটা ! যখন টের পেল তখন আর কিছু করার ছিলনা ওর । সংসারে সৎ প্রেমময় স্বামীটির আড়ালে যে ধোঁকার চিত্র আঁকছিল চিত্রকর তা রীমা কেন কেউই জানতে পারেনি যতদিন না আবীর নাঈমাকে নিয়ে দেশের বাইরে চলে গেল খুব গোপনে । যাওয়ার পর ডিভোর্স লেটার পায় রীমা । ঋতুটাকে এসময় ওর খুব দরকার ছিল নিজেকে সামলে নেওয়ার জন্য , কিন্তু অভিমানী বোকা ঋতুটা মাকে কোন সুযোগ না দিয়ে আত্মহত্যা করে ফেল্ল ! অবশ্য ওরই বা কি দোষ ! একে এত ভালবাসার বাবা তার ওপর দীর্ঘদিনের বিশ্বাসী বোনের মত মনে করা নাঈমা । ছোট্ট বয়সন্ধিকালীন মনটা কিছুতেই মেনে নিতে পরেনি ব্যাপারটা । একদিকে মৃত সন্তান আরেকদিকে স্বামীর ধোঁকা ! এতবড় মানসিক ঝড় সামাল দিতে পারার শক্তি বোধহয় ওর ভোর ওকে যোগাতে পারেনি । তাই একই স্বপ্নে বিভোর হয়ে কল্পরাজ্যে বিচরণ করে কাটে রীমার দিনরাত্রি । বোধহীন জড়পদার্থের মত পাগলা গারদের ছোট্ট একটা ঘেরে ওর ভোর আসে আবার রাত হয় । এমনভাবে রীমার জীবন কেটে যায় মিথ্যে স্বপ্নের গোলক ধাঁধায় পথ খুঁজে খুঁজে । সারাক্ষন সে মনে মনে সুন্দর সাজানো সংসারকে কল্পনা করে তাতে বসবাস করে ওষুধের প্রতিক্রিয়ায় । মাঝে মাঝে অবশ্য পাগলামী অশান্ত পর্যায়ে চলে গেলে কড়া সিডেটিভে স্বান্তনা দিতে হয় ওকে ! আরো একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বোনটার মাথায় একটু হাত বুলিয়ে দিয়ে সেল রুম থেকে বেরিয়ে আসে বিপ্লব । আবার সামনের মাসে বা তার পরের মাসে যখন সময় করতে পারবে তখন হয়তো বোনটাকে আবার দেখে যাবে !