ছোটগল্প

মোহাম্মদ জাহিদ হোসেনের ছোটগল্প- শুধুই অন্ধকার

শুধুই অন্ধকার
মোহাম্মদ জাহিদ হোসেন


প্রচন্ড ব্যাথা উঠেছে অভিকের হার্টে । অভিকের হার্টে আগে থেকেই রিং লাগানো ছিল । আজ হঠাৎ করে তীব্র ব্যাথা উঠেছে । কোন ভাবেই যেন ব্যাথাকে আর সহ্য করতে পাছে না অভিক। তাই বাধ্য হয়েই পাশের বাসার মামুন সাহেব কে ডাকতে হলো । মামুন সাহেব এসে তাড়া তাড়ি একটি এ্যাম্বুলেন্স ডাকলো। প্রায় ৩০ মিনিটের মাথায় এ্যাম্বুলেন্স এলো । অভিকে টলিতে করে নিয়ে যাচ্ছে এ্যাম্বুলেন্সর দিকে। এ্যাম্বুলেন্স চলতে আরম্ভ করলো , সে সময় অভিকের চোখ দুটি কেমন যেন ভাড়ী হয়ে উঠলো। অভিকের চোখের সামনে ভেসে উঠলো ফেলে আসা সেই সব দিন গুলো , এই তো সেদিন সে সংসার জীবন শুরু করেছিল কবিতা কে নিয়ে , সংসারের সব লেনদেন, কেনাবেঁচা, দেওয়া নেওয়ার শেষ- তাই তো মনে হলো অভিকের । আর তারপর থেকেই সব দিতে হলো অভিক কে ।

কী কী দিয়েছে অভিক ? এই প্রশ্ন অভিকের আগে কবিতাকে জিজ্ঞাসা করা প্রয়োজন !

প্রথম যেদিন অভিক কবিতাকে নিয়ে এলো ঘরে, সেদিন কবিতা অভিক কে বলল , ‘ নতুন ঘর, নতুন সব, নতুন করে শুরু সব ‘। হ্যাঁ তারপর থেকেই অভিকের কাছে প্রতিটি দিন নতুন, প্রতিটি সকাল নতুন, প্রতিটি রাত নতুন, কবিতার হাতের আদর নতুন, বিছানায় পাতা চাদর নতুন।

কিন্তু, পুরনো প্রিয় জিনিসগুলো ছেড়ে এসেছে অভিক। কবিতা সে দিন জানতেও চায়নি সেদিন যে কী কী ছেড়ে এছেছিল অভিক?

তাই, অভিবকের মনে পড়তে থাকলো কি কি ছেড়ে এসেছিল সে।

– ২৫ টা বছর, যার বারোটা শৈশব, আর বাকিটা বুঝতে বুঝতে বড় হওয়া যে, ‘ তোর উপর অধিকার কেউ অর্জন করে নেবে।’ আর ছেড়ছিলো মা-বাবার যত্ন, মায়ের আদর, ভাইদের সাথে খুনসুটি, বিকালে এলাকার বন্ধুদের সাথে আড্ডা , সন্ধ্যায় একথালায় মাখা মুড়ি ৩ ভাই মিলে খাওয়া, শীতের রাতের বৃষ্টি আর এক লেপের নিজে ৩ ভাই মিলে একটু উত্তাপ খোঁজা, লোকাল বাসে করে বন্ধুদের সাথে ইউনিভার্সিটি থেকে ফেরা, আরও কত কী।

না না। যা অভিক ছেড়ে ছিল তা ফেরেবার নয়। হারানো বিকাল ফেরে না ; কৈশোর ফেরে না ; আস্তে আস্তে বড় হবার কৌতুহল ফেরে না, নতুন চেনা বসন্তের শিহরন ফেরে না। শুধু ফিরে ফিরে আসে- তোলপাড় করা হৃদয়ের ফিরে আসার ডাক।

এগুলো সব ছেড়ে, কবিতাকে নিয়ে অভিককে নতুন করে শুরু করতে হল, কত সহজেই বলে ছিল কবিতা নতুন জীবনের কথা , কিন্তু কবিতা এতটুকু বোঝোনি নতুন করে শুরু করা কতটা কঠিন ছিল অভিকের জন্য।

নিজের কিছু আছে -এখন আর বুঝতে পারে না অভিক। আগে সবই অভিকের নিজের ছিল। মায়ের শাসন,বাবার আদর নিজের ছিল, বাবার আনা যে কোন উপহার ভাইদের এর সাথে ভাগ করে নেওয়া ছিল, তবুতো নিজের ছিল, মায়ের হাতের রান্না, তাও তো নিজের ছিল।
আর এখন কবিতা বল্ল ‘ তাকে নিজের করে নেবার জন্য’।

বেশ,অভিক কবিতাকে নিজের করে নিল।

কবিতার মাকে ‘মা’ বলে নিজের করে নিল, সংসারকে আপন জেনে নিজের করে নিল, কবিতার রাত দুপুরের সব আবদার নিজের করে নিল। এক সময় অভিক কবিতার সংসারে দুটি কন্যা সন্তান আসলো। সন্তানদের সব বায়না নিজের করে নিল। অভিক কবিতা আর তার সন্তানদের সহ সবার ভালো থাকার ব্যাবস্হ্যা করলো ।নিজের দিকে না তাকিয়ে সব কিছুকে উজার করে দিল কবিতার তরে ।কবিতার উচ্চভিলাসী সব আবদার মেটাবার জন্য অভিক নিজেকে আস্তে আস্তে শেষ করে দিতে লাগলো। কোন দিন খেয়ে না খেয়েই অফিসে যেত অভিক ,আর হয়তো মাসে এক কি দুবার দুপুরের খাবার ভাগ্যে জুটতো অভিকের কারন যে টাকা দিয়ে দুপুরের খাবার খাব সে টাকা দিয়ে সংসারের জন্য এটা ওটা নিয়ে আসতো আর এতে কবিতা বেশ খুশি হতে কিন্তু একবারের জন্যও জানতে চায় নি এ গুলি কি ভাবে আনলো। এ ভাবে নিজের জীবনকে কষ্ট দিতে দিতে আস্তে আস্তে গড়েছিল কবিতার সংসার । যখন কবিতার সংসার কানায় কানায় পূর্ণ , সে সময় কবিতা আধুনিক সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে নিজেকে আরো আধুনিক করার চেষ্টা করতে লাগলে। আধুনিকতা কবিতাকে এতটাই গ্রাস করলো যে সংসারের বন্ধন কবিতার কাছে এক কারাগার মনে হতে লাগলো। মেয়ে দুটি কবিতার আধুনিকতার পথে বড় বাধা হয়ে দাড়ালো। কবিতার প্রতি অভিকের অন্ধ ভালোবাসা এ সব কিছুকে কবিতার ছেলে মানুষী কাজ বলেই মনে করতে লাগলো । কবিতা অভিককে কেবলি টাকা বানাবার মেশিন হিসাবে ভাবতে লাগলে। অভিক তার মেয়েদের মুখের দিকে তাকিয়ে আর কবিতার প্রতি প্রচন্ড ভালোবাসা বোধ থেকে বাধ্য হয়েই তোমার সব কিছুকে মুখ বুজে সহ্য করতে লাগলো। সহ্য করতে করতে আর পরে উঠছে না অভিক , বুকের ভিতরের জমে থাকা প্রচন্ড দুঃখ গুলি এক সময় বন্ধ করে দিল অভিকের হার্টের কাজ করার ক্ষমতাকে , হঠাৎ হার্ট অ্যাটাক করলো অভিক , অভিক সে সময় দাড়ালাম জীবন আর মৃত্যুর মাঝে । হাসপাতালের বেডে যে সময় অভিক জীবন আর মৃত্যুর মাঝে সে সময়ও কবিতার এতটুকু বোধ নেই । অভিকের হার্ট অ্যাটাক যেন তার জীবন চলার পথে ব্যাঘাত ঘটালো। সাতদিন হাসপাতালে থেকে যে সময় অভিক জীবন আর মৃত্যুর সাথে যুদ্ধ করছি তার মধ্যে কবিতা কেবল দুবার এসেছিল । অভিক ভাবতো এটাই হয়তো তার ভাগ্য লিখন। বাসায় যাবার পরে মনে হলো অভিক যেন নিজের ইচ্ছায় আমার হার্ট অ্যাটাক করেছে। ১০ দিন পরেই আবার অফিস আরম্ভ করলো অভিক । শরির যেন কছিুতেই চলতে চায় না তবুও সংসারের চিন্তা করে প্রতি দিন অফিস করে অভিক , সারাটা দিন অফিস করে যে সময় ক্লান্ত দেহ নিয়ে বাসায় ফিরে অভিক, সে সময় তার মনে চায় একটু বিশ্রাম নিতে কিন্তু কবিতার জ্বালায় সে উপায় টুকুও অভিকের নেই । এটা সেটা করতে করতেই কটে যায় সময়। তার পরে রাতের খাবার খেতে হয় ১২ টার পরে । কারন অভিক কে রান্না করতে হয় , মাঝে মাঝে অভিক মনে করে আর সে রান্না করবো না কিন্তু মেয়ে দুটির দিকে তাকিয়ে অভিক আর পারে না । আর সে সময় কবিতা ব্যাস্ত তার ইন্টারনেট আর ফেসবুক নিয়ে। মাঝে মাঝে অভিকের মনে হয় এ যেন নিজের কাছে নিজের শর্তহীন আত্মসমর্পণ । অনেকে অভিক কে প্রশ্ন করে কেন অভিক এগুলি সহ্য করে ? কেউ কেউ বলে ওর কবিতার মাঝে কি গুপ্তধন আছে, নাকি আছে বিশাল কোন এয়ারপোর্ট ? উত্তরে অভিক শুধু বলতো “ আমি যে ওক প্রচন্ড ভালোবাসি ” । অভিকের শারিরিক সমস্যা কোন সময় কবিতা বুঝে না। অভিকের বড় মেয়ে সেও তার মায়ের মতোই। সব সময় নিজেকে নিয়ে ব্যাস্ত। অভিকের জন্য আসলে কেউ তার সময় ব্যায় করতে চায় না। শুধু তাদের টাকা আর টাকার দরকার। অভিক আসলে ওদের প্রতি ভালোবাসায় এতোটাই অন্ধ ছিল যে ওদের এই অবহেলাকে অভিক সব সময় ওদের বোঝার ভূল হিসাবে ধরে নিত। অভিকের শুধু একটাই চিন্তা তার ছোট মেয়েটার কি হবে? অভিক ছাড়া যে ওকে দেখার মতোন তো আর কেউ নাই। শুধু এ চিন্তাই এই মরা শরিরটাকে বয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছিল অভিক । কবিতা আর তার মেয়ের প্রচন্ড অবহেলায় আজ অভিক মৃত্যুর দিকে। এক সময় অভিকের জীবনটাও ভরা নদীর মতোই ছিল , ছিল চরম প্রবাহ । অভিক কেবলি চাইছিল সাগর মোহনায় যেতে। এ প্রবাহমান জীবনে সবার জন্য যা কিছু করার দরকার ছিল তার সবি অভিক করেছিল। ভাই ,বাবা মা, সবাইক উজাড় করে দিয়েছিলাম নিজের যা কিছু ছিল। অথচ আজ অভিক দ্রুত গতির এ্যাম্বুলেন্সে চলেছে অজানা এক শীতল জীবনের দিকে। আজ এ সময় অভিকের বড় জানতে ইচ্ছা করছে, “ জীবনতো একটাই ,তবু এক জীবনে এত কষ্ট কেন? ” অভিক জানে এর জবাব কারো কাছে নেই। প্রচন্ড ব্যাথায় আর নিজেকে স্হীর রাখতে পরছে না অভিক ,আজ সামান্য দূরত্ব কেন যেন অভিকের কাছে বেশ দূরের লাগছে। আস্তে আস্তে অভিকের চোখের পাতাটা ভারী লাগছে, বাইরের আলো গুলো ক্রমশ দূরে সরে যেতে লাগলো, চারপাশেরে শব্দ গুলো কেন যেন অদ্ভুত ভাবে কানে লাগতে লাগলো অভিকের । আস্তে আস্তে অভিকের শরিরটা হালকা লাগতে লাগলো। হঠাৎ এ্যাম্বুলেন্সের ব্রেকেরে সাথে চারিদিক আলোহীন হয়ে গেল,হয়তো এটাই অভিকের জীবন আর মরনের সন্ধিক্ষন। তার পর সব শুধুই অন্ধকার…

লেখার তারিখঃ- ০২-০৪-২০১৮

Related Posts