গবেষণামূলক প্রবন্ধ প্রবন্ধ

ড. এস এ মুতাকাব্বির মাসুদের গবেষণা প্রবন্ধ- ‘কল্লোল’ তারাশঙ্কর : শরৎ এর সতর্ক উপলব্ধি (তৃতীয় পর্ব)

‘কল্লোল’ তারাশঙ্কর : শরৎ এর সতর্ক উপলব্ধি (তৃতীয় পর্ব)
ড. এস এ মুতাকাব্বির মাসুদ


এই প্রথম অস্থির জীবনদর্শনের বৃত্ত ভেঙ্গে তারাশঙ্কর সুস্থ মাটিঘেঁষা সমাজজীবনের পটভূমিতে নিজেকে মেলে ধরলেন।বাংলাসাহিত্যের প্রথম আঞ্চলিক উপন্যাস ‘কয়লা কুঠি ‘(১৩২৯) যাঁর হাত দিয়ে বেরিয়ে এসেছিলো তিনি কীর্তিমান ঔপন্যাসিক শৈলজানন্দ(১৯০০-১৯৭৫)। এই শৈলজানন্দের মতো তারাশঙ্করের অধিকাংশ উপন্যাসের অন্তঃপুরে বিন্যস্ত পটভূমিও ‘স্থানিক’ ; আর এ স্থানিক জীবনের দুঃসহ ক্রমবিন্যাসের সাথে স্থানিক জীবনবোধের আবর্তনে বিস্তৃত সমাজচেতনা ব্যুৎপুন্ন অনুধ্যানে সংশিত সংশ্লেষে তাঁর উপন্যাস হয়ে ওঠেছে আরো বেশি জীবনঘনিষ্ঠ ও জনপ্রিয়। কেবল শরৎচন্দ্র
(১৮৭৬-১৯৩৮) ও শৈলজানন্দের আবেগ নয় সুগভীর সহানুভূতি ও আধুনিক জীবনবিশ্লেষণের মাধ্যমে তিনি সাহিত্যের মেধাবী অঙ্গনে প্রবেশ করেন নিজস্বতায়-অতি সচেতনভাবে বাঙালির ‘ক্রান্তিকালীন সমাজজীবনের মর্মস্থলে’।
শরৎচন্দ্র ও তারাশঙ্করের সতর্ক উপলব্ধি
গ্রামীণ সমাজকে কেন্দ্র করে।এরূপ চিন্তা-চেতনার সাযুজ্যকে মেলে ধরে সন্দেহ নেই। তাঁদের উভয়ের মধ্যে
পল্লীসমাজের বিদ্যমান জীবন বাস্তবতার নৈর্ব্যক্তিক অনুষঙ্গগুলো উপলব্ধির বিবর্ধনে উদ্দীপিত ছিলো।আর তারই সচিত্র প্রয়াস ওঠে এসেছে গ্রামীণ সমাজের আনন্দ-বেদনা,ধর্ম-সংস্স্কার ও প্রচল মূল্যবোধের পটভূমিতে। তিনি তা দক্ষ শিল্পীর মতো মূর্ত করেছেন
ধ্যানে-মননে, প্রজ্ঞার অবিনাশী আলোয় শিল্প কিংবা উপন্যাসে। তবে উল্লেখ্য শরৎচন্দ্র ও তারাশঙ্করের উপস্থাপিত বিষয়ে কিছু মৌলিক পার্থক্য পর্যবেক্ষণে ওঠে আসে। শরৎচন্দ্রের গ্রাম-বাংলার প্রেক্ষিত অংকিত চিত্রে গ্রামীণ মানুষের হৃদয়বৃত্তির উপর নিরঙ্কুশ আলোকপাতের স্বতঃস্ফূর্ত অবভাসের বিষয়টি চোখে পড়ার মতো।তুলনায় তারাশঙ্কর নিজেকে সমাজ বাস্তবতায় সংযত ধারায় নিয়োজিত রাখার অভিপ্রায়ে কখনো স্মৃতিতে তুলে এনেছেন ক্ষয়িষ্ণু সামন্তজীবনের করুণ চিত্র কখনোবা লোকজীবনের রোমান্টিক রূপচিত্রে সহজিয়া,বৈষ্ণব,বেদে-সাপুড়ে,ডুম-বাউড়ির জীবনগাঁথা! আবার কোনো কোনো সময় সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থার কঠিন চাপে নিরুপায় দিশেহারা প্রান্তিক কৃষক কর্তৃক শ্রমিকবৃত্তি গ্রহণের সকরুণ অসাহায়ত্বের চিত্র যেমন ওঠে এসেছে তেমনি তাঁর বিমূর্ত স্মৃতির নিভৃত আঙিনায় দৃশ্যমান হয়ে ওঠেছে সমকালীন জাতীয় আন্দোলনের যৌক্তিক দৃশ্যপট ও তাঁর দীপ্ত সমাজচেতনা। গ্রামের বৈচিত্র্যময় প্রকৃতি, ঋতুবৈচিত্র্যের লীলা,হাজার বছরের বাংলার লোকজ সংস্কৃতি কিংবা গ্রামের বিচিত্র শ্রেণি-মানুষের আচরিত আঞ্চলিক প্রথা ও মূল্যবোধ ; পাশাপাশি যুগপরিবর্তনের সংঘাত প্রভৃতি এক দীপ্যমান শৈল্পিক উৎকর্ষ নিয়ে তাঁর উপন্যাসে দ্যুতিত ধারায় উদ্ভাসিত হয়েছে। শরৎচন্দ্রের মতো তারাশঙ্কর শুধুই নরনারীর বিচিত্র হৃদয়-রহস্যের উন্মোচনেই তৃপ্ত ছিলেন না।
বস্তুত শরৎচন্দ্র গ্রামীণ চিত্র আঁকতে যেয়ে বিশেষ উদ্দেশ্যকে সামনে নিয়ে এসে পল্লীসমাজের একটি খণ্ডাংশকে নির্বাচিত করেছেন, যা কখনো-ই সমাজের সমগ্রতাকে নির্দেশ করে না। বলা যায় এটি তার সমকালীন রচনার বিজ্ঞাপিত রমেশ-রমার বিরোধ-তিক্ত চরিত্রের দুর্জ্ঞেয় প্রভাব থেকে উপস্থাপিত কিংবা পক্ষান্তরে অস্বীকৃত প্রণয়ের মসৃণ-কোমল সম্পর্কের পটভূমিকা যা উদ্ধৃত সত্য!কিন্তু পরোক্ষ বিবেচনায় এটি পল্লীজীবনের সংকীর্ণ স্বার্থপরতা ও ঘৃণ্য নৈতিকতা ও আদর্শের বাস্তব চিত্র।
তারাশঙ্কর গ্রামীণ জীবন ও সমাজের মূল প্রবাহ অনুসরণে নির্দ্বিধায় নিজেকে প্রান্তিক জীবনবাস্তবতার কঠিন প্রতিবেশে এক অন্তর্ভেদী উপলব্ধিতে অন্বিত হওয়ার প্রয়াস পান। শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন ‘ ইহার উৎসাহ অবসান, গৌরব গ্লানি,বাঁচিবার আকাঙ্ক্ষা ও মরণধর্মী জড়তা,নতুন ভাবের ও প্রয়োজনের সংঘাতে ও পুরাতন আদর্শের ভাঙ্গনে ইহার অসহায় কর্তব্য বিমূঢ়তা এই সমস্তই কোন বিশেষ উদ্দেশ্যের কেন্দ্রানুগ না হইয়া তাঁহার রচনায় অভিব্যক্তি লাভ করিয়াছে।’

 

“””””””””””””””””””””””””””””””‘””””””””””
০৮-০৪-২০১৮
“”””””””””””””””””””””””

 

Related Posts