অজানা অনুভূতি
মনি রয়
“কুকুর জাতিকে আমার বরাবরই ভীষণ ভয়। ছোটবেলা ঠাকুমা দিদিমার কাছে শুনেছি কুকুর ঘরে ওঠা ভাল লক্ষণ নয়। তাতে নাকি সংসারে শনির প্রকোপ দেখা দেয়। যদিও সেটাতে আমি বিশ্বাসী নই। আর এ হেন কুসংস্কারও আমার কুকুর জাতির থেকে দুরে থাকার কারণ হয়ে দাড়ায় নি।
তবে কোন না কোন ভাবে বাসু কাকার মৃত্যুটা হয়ত এর জন্য দায়ী। জলজ্যান্ত ছেলেটাকে চোখের সামনে ভয়ানক মৃত্যু যন্ত্রণায় ছটফট করতে দেখেছি। যদিও আমি তখন বেশ ছোট। ডাক্তার বলেছিল বাসু কাকার নোখের আচঁড় ও যদি কারো গায়ে লাগে তাহলে তারও নাকি মৃত্যু অনিবার্য।
তাই মা আমাকে মামা বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছিল।
মামা বাড়ি ছিল বাড়ির পাশেই, তাই আমি বারবার ছুটে আসতাম বাড়িতে আর তাকিয়ে থাকতাম বাসু কাকার দিকে। জীবনের শেষ দিন বাসু কাকা আমার মা এর কাছে ইলিশ মাছ খেতে চেয়েছিল বলেছিল বউদি তুমি ইলিশ ভাপে টা বড় ভাল বানাও খাওয়াবে আমায় করে শেষ বারের মত।
হাউ হাউ করে কেদেঁছিল সেদিন মা। বড় ভালবাসত বাসু কাকাকে। বানিয়েওছিল ইলিশ ভাপে কিন্তু খেতে পারেনি এক গ্রাস ও। খাদ্য নালি বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। জলটুকুও গিলতে পারত না। চোখের সামনে দেখেছিলাম সেই অসহ্য যন্ত্রণা। কুকুরের একটা আচঁড় আর তার ভুল চিকিৎসা কেড়ে নিয়েছিল হাসি খুশি বাসু কাকাকে আমাদের সকলের কাছ থেকে….সেই থেকেই এদের থেকে আমি একটু দুরেই থাকি।
ভাই একবার বায়না ধরেছিল বাড়িতে কুকুর পুষবে। মা আর আমি দুজনের প্রচেষ্টায় সেটা সম্ভব হয়ে ওঠেনি। কিন্তু ওই যে কথায় বলেনা যেখানে বাঘের ভয় সেখানেই সন্ধ্যে হয়। শ্বশুরবাড়িতে এসে দেখলাম একখানা নয় দুখানা কুকুর বাবা জীবনের রাজত্ব ।যদিও বিয়ের আগেও জানতাম যে এনারা এই বাড়িতে বেশ গুছিয়ে পরিবারের সদস্য হয় জাকিয়ে বসেছেন।
ভালবাসার বিয়ে তাই কি আর করার। কুকুরের জন্য তো আর ভালবাসার মানুষটাকে ত্যাগ করতে পারিনা তাই এই সদস্য দুজন কে দেওর আর ননদ হিসেবে মেনে নিতেই হল অগত্যা। নাম ছিল তাদের রানি আর রিকি। তবে একদিকে বাঁচোয়া ছিল এদের দায়িত্ব আমাকে কখনোই নিতে হয়নি।
প্রথম দিন রিকি আমাকে দেখেই ঝাঁপিয়ে পড়েছিল বোধহয় একটু হিংসেই হয়েছিল ওর আরো একজন নতুন সদস্যের আগমনে।আমারও খুব রাগ হয়েছিল কিন্তু সেটা আর প্রকাশ করতে পারিনি। যতই হোক নতুন শ্বশুরবাড়ি বলে কথা। আমার বিয়ের কয়েকদিন এর মধ্যেই রিকি গত হল। বয়স হয়ে গিয়েছিল তাই। রয়ে গেল রানি। আর ততদিনে সকলেই জেনে গেছে যে আমি খুব একটা কুকুর প্রেমী নই তাই আমার কাছে যাতে রানি না আসে সেরকম চেষ্টাই সবাই করত।
ওকে নাকি আমার কর্তাই এনেছিল এই বাড়িতে। ব্যাস ওই টুকুই। আর কোন দায়িত্বই তিনি পালন করতেন না। রানির সমস্ত দায়িত্ব ছিল মা এর ওপরে। ওকে খাওয়ানো স্নান করানো ওর মল মূত্র পরিষ্কার করা ওর গায়ের পোকা বাছা সমস্তটাই একার হাতে করত। আমাদের বাড়িতে তিনটে ছাদ। প্রথমটা থেকে দ্বিতীয়টাতে যাওয়ার আবার দ্বিতীয়টা থেকে তৃতীয় টাতে যাওয়ার আলাদা গেট রয়েছে। রানি বরাবর মাঝখানের ছাদেই থাকত। আর সেই কারণে আমার ইচ্ছে হলেও দ্বিতীয় বা তৃতীয় ছাদে যাওয়া হতনা। বেশ রাগ হত।
আজ অনেক দিন বাদে ছাদে গিয়েছিলাম দুপুরের মিষ্টি রোদ গায়ে মাখাতে। অল্প অল্প ঠান্ডা পড়েছে তাই স্নানের পরে গায়ে একটু রোদ মাখাতে মন্দ লাগেনা। আজ ছাদে গিয়ে বুকের ভেতরটা কেমন যেন একটা করে উঠল। প্রথম ছাদ থেকে দ্বিতীয়টাতে যাওয়ার গেটটা খোলা। যেটা কখনই খোলা থাকতনা রানির জন্য । কয়েকদিন হল রানি আর নেই। ভীষণ অসুস্থ হয়ে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেছে। কথাটা মনে পড়তেই বুকের ভেতরটা হু হু করে উঠল। মাঝ খানের ছাদটা ফাঁকা। এখন তো ইচ্ছে মত তিনটে ছাদেই যেতে পারব তাহলে ভাল লাগার বদলে এত খারাপ লাগছে কেন? আমি তো ওর জন্য কোনদিন কিছুই করিনি সবসময় দুরে দুরেই থেকেছি তাহলে এই অনুভূতির মানে কি। এত বছর ধরে ও এই বাড়িতে ছিল এই অভ্যেসটাই কি আমায় কষ্ট দিচ্ছিল? ওর জন্যে রাখা গামলা বাটিটাতে ওর নাম করে আর খাবার রাখা হয়না, তবুও বাটিটার নাম রানির বাটি। বাটিটার দিকে তাকালেও একটা অজানা খারাপ লাগা মনটাকে আক্রান্ত করে। এ যেন এক অজানা অনুভূতি , অনেক ভেবেও এই খারাপ লাগার মানেটা উদ্ধার করতে পারলাম না।।