অনিশ্চিত গমন ।
বাবুল হোসেন বাবলু
পরের অধীনে চাকরী করা চৌধুরী পরিবারের শানের খেলাপ -দিন মজুরী সেও বিবেকের বাধা ।নামের শেষে চৌধুরী লিখতেও এখন সমরের বিবেকে সায় দেয়না ।পুরনো বাড়িটা মেরামত হয়না কতকাল -চুন সুড়কির আস্তরণ খসে পড়ছে -উপর তলার হাড় জিরজিরে ইটগুলো কাতর দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ।বাপ দাদার আমলের এই বাড়িটাই স্মৃতির স্বাক্ষর হয়ে অবশিষ্ট আছে ।এলাকার প্রথম দ্বিতল পাকা বাড়ি-দূর দূরান্ত থেকে লোকজন বাড়িটি
দেখতে আসতো ।
কারুকাজ করা বিশাল সুউচ্চ তোরণ বাড়ির প্রবেশ দ্বারে ।জুতা পায়ে কোন বাইরের দর্শনার্থীর প্রবেশাধিকার ছিলোনা চৌধুরী বাড়িতে -ভুল ক্রমে কেউ জুতা পায়ে প্রবেশ করলে পেয়াদারা গোয়াল ঘরে নিয়ে জুতাপেটা করতো – জমিদার ভবরঞ্জন বাবুর কঠোর নির্দেশে ।
চৌধুরী ওদের পুরানো খেতাব -আজকাল জমিদার তো নয়ই চৌধুরী বলতেও অনেকে নারাজ ।সমরের ঠাকুরদা বাবু ভবরঞ্জন চৌধুরীর জমিদারী তিন গ্রামে সীমাবদ্ধ ছিলো -খাজনাপাতি আদায় করে সরকারী তহসিল অফিসে জমা করে বড় আকারের কমিশন পেতেন -অনাদায়ে গরীব ভূমি মালিকদের জমি দখল ।কঠিন হৃদয়ের মানুষ -দয়া করুণা তার অভিধানে ছিলোনা ।
পট পরিবর্তন -সাতচল্লিশের মহাত্মা গান্ধীর অসহযোগ আন্দোলন -পরবর্তীতে মহাভারতের স্বাধীনতা ।হাত ছাড়া হয়ে যায় জমিদারী প্রথা ।মানুসিক ভাবে দুর্বল ভবরঞ্জন চৌধুরীর এক মেয়ে এক ছেলে ।সতেরো আঠারো বছরের মেয়েটিকে তড়ি-গড়ি করে পশ্চিমবঙ্গ নিবাসী তার মাসতুতো ভাইয়ের ছেলের সাথে বিয়ে দিয়ে দেন ।ছেলে অতীন মাত্র আট বছর-গৃহশিক্ষকের কাছে বাড়িতে পাঠগ্রহণ করেন ।এরই মাঝে শুরু হয় ভারত ভঙ্গের দাবীতে আটচল্লিশের হিন্দু মুসলিম দাঙ্গা ।বৃটিশের চক্রান্তে জিন্নাহ চাইলেন মুসলমানদের নিয়ে আলাদা রাষ্ট্র ।প্রচুর রক্তপাত আর লাশের সারিতে দাঁড়িয়ে মহাত্মা গাঁন্ধী অনিচ্ছাকৃত আলাদা পাকিস্থান সৃষ্টির পক্ষে মত দিলেন ।ফলে এপারের হিন্দুরা ওপারে -ওপারের মুসলিমরা এপারে আসতে শুরু করলো ।মানুসিক ভাবে আক্রান্ত বাবু ভবরঞ্জন চৌধুরী ধকল সামলাতে না পেরে মারা গেলেন ।সে সুযোগে বেদখলকৃত মুসলমানরা নিজ নিজ জমি দখল করে নিলো ।অতীনের মা অচলাদেবীর প্রতিরোধ করার ক্ষমতা বা ইচ্ছে কোনটাই ছিলোনা ।
আত্মীয় স্বজনরা অনেকেই দেশ ছাড়ছেন -অনেকের অনুরোধেও অচলাদেবী নিজের জন্মভূমি ছাড়তে নারাজ ।বাদ – বাকি জমিজমা সব অচলা দেবীকেই দেখাশুনা করতে হয় ।অতীন বড় হতে থাকে ভোগ বিলাসে -তখনো বিষয় সম্পদ নিতান্ত কম নয় ।শাশুড়ির দেয়া গহনা-ঘাটি সব অচলার সিন্দুকে রক্ষিত ।দিক নির্দেশনার অভাবে অতীন সময়ের স্রোতে গা ভাসিয়ে ক্রমশঃ নেশা পানিতে আসক্ত হয়ে পড়ে । সাথে জোটে পাড়ার মুসলমান বখাটে বন্ধুরা ।
প্রতিরাতে বাড়িতে মদের আসর -রাতভর ফুর্তির ফোয়ারায় গা ভাসানো ।অকার্যকর মায়ের বাধা নিষেধ ।বাড়ির সামনে পূজার মন্দির -প্রতি বছর দূর দূরান্ত হতে লোক আসে প্রতিমা দর্শনে -সাথে রাতভর যাত্রাপালা ।সন্ধ্যা হতে আরতি-শ্রুতিমধুর ভজন -কীর্তন -সে সাথে সপ্তাহব্যাপী ভোজন -প্রসাদ বিতরণ।
দোতলায় বন্ধুবেষ্টিত অতীন আকন্ঠ নিমজ্জিত মদের নেশায় ।শ্বশুরের অনুকরণে নিয়ম রক্ষা করতে গিয়ে অচলা দেবী অর্থশূন্য প্রায় ।
ছেলের পথ ভ্রষ্টতা লক্ষ্য করে মাত্র ষোল বছর বয়সে ছেলেকে বিয়ে করালেন ।আশা যদি পরিবর্তন হয় -হিতে বিপরীত !সুন্দরী স্ত্রী সরলাকে বিয়ের পরও অতীনের কোন পরিবর্তন নেই ।সারাক্ষণ বন্ধু বান্ধব মদের আড্ডায় রত দিন রাত । অচলা দেবীও তিনদিন জ্বরে ভুগে স্বামীর পথ ধরেন ।
বাংলাদেশে গণ আন্দোলন তখন তুঙ্গে ।শেখ মুজিবুর রহমানের দৃপ্ত আহব্বানে স্বাধিকার অর্জনে ঐক্যবদ্ধ গোটাজাতি ।অতীনের স্ত্রী সন্তান সম্ভাবা ।এলাকার হিন্দু মুসলিম দেশ ছাড়ছে -এককোটির উপরে লোক ভারতে শরণার্থী ।অতীনের যাওয়ার কিছুটা আগ্রহ থাকেলও তার স্ত্রী এবং মুসলিম বন্ধুরা যেতে দেয়নি -“আমরা রাতভর জেগে তোকে পাহারা দেবো অতীন -”সাহস দেয় বন্ধুরা ।অতি বৃষ্টি -লোকের অভাবে চাষাবাদ না হওয়াতে হাতের নগদ পয়সা শেষ ।মাত্র নয় মাসে ভারতের সহযোগিতায় স্বাধীন হোল দেশ । যুদ্ধের তিন মাস পর সমরের জন্ম ।জন্ম নিলো লাল সবুজে অঙ্কিত নতুন পতাকার ।সমরের জন্মের পর জমিজমা শূন্য অতীন ।আর্থিক দৈন্যতা সীমাহীন ।ভবিতব্যের অজানায় আশংকায় রোগাক্রান্ত হয়ে বিছানায় পড়ে অতীন ।বড় ডাক্তার দেখানোর সামর্থ্য নেই সরলার ।টাকা পয়সার অভাব আর অনভ্যস্ত অভাবের তাড়নায় দিনকে দিন অতীন অসুস্থ হয়ে বিছনায় পড়ে অকালে।বাতিল হয় সমরের উচ্চ মাধ্যমিক ফাইনাল পরীক্ষা ।বাড়ি ভিটে ছাড়া বিক্রি করার মত বাড়তি জমি নেই ।মা ছেলেকে দুঃখের সাগরে ভাসিয়ে পরপারে পাড়ি দেয় অতীন ।
দু’চোখে অন্ধকার দেখে সরলাদেবী ।সমরের কি জ্ঞান- বুদ্ধি হয়েছে ! চাকরী- দিন মজুরী কোন কিছুই সমরকে দিয়ে হবেনা ।দুঃসময়ে স্বামীর কোন হিতাকাঙ্ক্ষিকেই চোখে পড়ছেনা -যারা অর্থ বা কাজ দিয়ে সাহায্য করতে পারে ।সামনে কোন বিকল্প রাস্তা নেই সরলার -কি করবে পুরানো বাড়িটা পাহারা দিয়ে ?শাশুড়ির গহনা গুলো শেষ ভরসা – অগত্যা বাড়ি বিক্রি করে কলকাতায় যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় সরলা ।বড়দিকে সবিস্তার জানিয়ে চিঠি লেখে “এখানে একবেলা অন্ন সংস্থানের উপায় নেই -যেভাবেই হোক আমাদের নেয়ার ব্যবস্থা করো বড়দি ”।চিঠি সমরের হাতে পোষ্ট করতে দিয়ে বিছানায় শুয়ে উপুড় হয়ে অনবরত চোখের জল ফেলে সরলা দেবী ।চোখে ভাসে কলকাতার অনিশ্চিত ভবিষ্যতের ছায়া চিত্র ।
তারিখ: ২১-১১-১৭