প্রতিদান
চিন্ময় মহান্তী
নয়ন প্রত্যুষে একটি গামছা বাম স্কন্ধের উপর লইয়া বাহির হইল । দুই দিবস অতিবাহিত হইলেই বাবুর পৌত্রের অন্নপ্রাশন অনুষ্ঠান । বিস্তর কর্ম অসমাপ্ত রহিয়াছে ,খুব শীঘ্র সমাধা না করিলে অনুষ্ঠানে গোলোযোগ ঘটিবার সম্ভাবনা রহিয়াছে । অন্য সময় হইলে হয়তো কিঞ্চিত বিলম্ব করিয়া যাইত , কিন্তু বর্তমান সময়ে তাহা অনুচিত হইবে ভাবিয়া কাকভোরে নিদ্রা হইতে জাগিয়া উঠিয়াছে । সমস্ত রাত্রি জুড়িয়া তাহার নিদ্রা সুখের হয় নাই ।
পথের দুই প্রান্তে সুদূর বিস্তৃত ক্ষেত আপন বিস্তৃতি লইয়া একটি শান্তির বিছানায় শুইয়া রহিয়াছে । তাহাকে অতিক্রম করিলেই ‘ দুগ্ধা ‘ গ্রাম । সেই গ্রামেরই বিত্তশালী জীবন মুখুজ্যের গৃহে দীর্ঘ দশ বৎসর ধরিয়া সে ক্ষেত বাড়ীর কর্ম করিয়া আসিতেছে । তাহার পিতা বর্ষার পূর্ণ নদীতে মৎস্য শিকারে গিয়া যেদিন আর ফিরিয়া আসিলেন না , তাহার কিযৎকাল পর হইতেই সে এই গৃহে পিতার স্থান পূর্ণ করিয়া দিয়াছে ।
নয়ন পথ ধরিয়া হাঁটিতে হাঁটিতে অকস্মাৎ থামিয়া গেল । তাহার হৃদয় বড়ই বিষন্ন হইয়া উঠিল । কয়েকদিবস পূর্বেই ক্ষেতের বক্ষ ভরাইয়া যে হরিৎ হরিৎ ধান্যপত্রগুলি মৃদু হাওয়ায় নৃত্য করিত , অদ্য তাহারা তাহাদের বর্ণ হারাইয়া ধূসর হইয়া ক্ষেত্রস্বামীর খামারে পলুই হইয়া রহিয়াছে । ক্ষেতের এই রূপ দেখিয়া তাহার মনে পড়িল , শিশুকালে পাঠশালায় পড়িয়াছে , ” সোনার সীতারে হরেছে রাবণ ……. ।” এই কবিতার পরবর্তী লাইনগুলি কি রহিয়াছিল তাহা আর তাহার মনে পড়িল না । সে ভাবিল , সে তো বাবুর ক্ষেতের ধান কাটিয়া লইয়া তাহাদের পলুই নির্মাণ করিয়াছে , তাহা হইলে সে রাবণ হইয়া গিয়াছে । তাহার আপন হৃদয় মধ্যে একটি পাপ বোধ জাগিয়া উঠিল । ভাবিল যাহাদের সে আপন হস্তে রোপণ করিয়া লালন পালন করিয়া বড় করিয়া তুলিল তাহাদেরই সে কর্তন করিল , ইহা অপেক্ষা অধিক পাপ আর কি হইতে পারে । বিলাপ করিতে করিতে সে মনমধ্যে একটি তত্ত্ব খুঁজিয়া শান্তি পাইল যে , তাহার হরণ কৃত অন্নে বহু জীবের ক্ষুধা নিবৃত্তি হইবে তাহা হইলে সেই পুণ্য আসিয়া এই পাপের প্রায়শ্চিত্ত হইবে । এই সব চিন্তা করিয়া নয়নের চক্ষুর কোনায় অশ্রু আসিয়া পড়িয়াছিল , গামছার খুঁট দিয়া তাহা মুছিয়া সে জীবন মুখুজ্যের গৃহের উদ্যেশ্যে চলিল ।
যখন মুখুজ্যে বাড়িতে পৌঁছাইল দেখিল, কর্তা একটি কাগজ লইয়া চালানের আকারে কাটিয়া একটি সুদীর্ঘ ফর্দ লিখিতেছেন । তাহার পুত্র নবীন সেইটির প্রতি মনসংযোগ করিয়া চাহিয়া রহিয়াছে । নয়নকে দেখিয়া পঞ্চাশোর্দ্ধ জীবন বলিলেন , ” যা একটু চা খেয়ে নিয়ে কাজে লেগেপড় , এখনো তো নিমন্ত্রিতদের বসিয়ে খাওয়ানোর জায়গাটাই পরিষ্কার করতে পারলি না । ” নয়ন উত্তর করিল , ” ঠিক আছে কর্তা আজই করে দেব । ”
” আচ্ছা বেশ যা তাহলে , দেখিস যেন একটিও ঘাস না থাকে । ”
” ঠিক আছে কর্তা ” বলিয়া নয়ন চা পান করিতে রন্ধনশালার সম্মুখে গেল । যদিও বর্তমানে চেয়ার টেবিলে বসিয়া ভোজনের প্রচলন হইয়াছে তথাপি জীবন এই প্রথা অবলম্বন করিতে চাহেন না । তিনি এই প্রসঙ্গে একটি কথাই বলিয়া থাকেন , ” গোবর নাতা দিয়ে খামার পরিষ্কার করে ,সেখানে বসিয়ে ব্রাহ্মণভোজনের রীতি তার বাপ ঠাকুরদার আমলের ঐতিহ্য ।” নবীন বর্তমান প্রথা অবলম্বন করিতে চাহিয়াছিল , কিন্তু পিতার দৃঢ়তার নিকট হার মানিয়া লইয়াছে ।
চা পান সমাপন হইলে নয়ন একটি দীর্ঘ হাতল যুক্ত কোদাল লইয়া মৃত্তিকা হইতে তৃণ উৎখাত করিতে লাগিল । দীর্ঘ ফর্দটিকে গোল করিয়া গুটাইয়া লইয়া নবীন বাহির হইয়া গেল । কর্তা গৃহিনীর উদ্যেশ্যে রঙ্গ করিয়া বলিলেন , ” বলি বুড়োটাকে কি না খাইয়ে মারবে না কি । ”
অনুষ্ঠানের সমস্ত আয়োজন সম্পন্ন হইয়াছে । কল্য অনুষ্ঠান । অদ্য প্রাতরাশ সময় অতিবাহিত হইয়া মধ্যাহ্ন হইয়াছে । কুটুম্ব সজ্জন আসিতে আরম্ভ করিয়াছেন । নয়ন তাহাদের মালপত্রগুলি তাহাদের রহিবার নির্দিষ্ট কক্ষে তুলিয়া রাখিতেছে । সমস্ত গৃহে একটি কোলাহল হইতেছে । গৃহকর্তা তাহার নব জামাতার সহিত আলোচনায় ব্যস্ত রহিয়াছেন । নবীন হালুইকারদের সহিত ফর্দ মিলাইয়া লইতেছে । এক্ষনো আসিতে যিনি অবশিষ্ট রহিয়াছিলেন কর্তার শ্যালক , তিনিও আসিলেন । নয়ন তাহার মালপত্র তুলিয়া রাখিয়া জীবনের নিকট বিদাই লইতে গেল । তাহাকে দেখিয়া জীবন কহিলেন , ” কিছু বলছিস ? ”
” বলি কর্তা আমি তাহলে আসি । ”
” কাল তাহলে সকাল সকাল আসিস । ”
” ঠিক আছে কর্তা ।” বলিয়া নয়ন বিদাই লইল । যাইতে যাইতে ইহা ভাবিয়া কষ্ট পাইতে লাগিল যে , কর্তাবাবু তাহাকে সপরিবারে আসিতে নাইবা বলিতেন অন্তত তাহার পুত্রকে লইয়া আসিতে বলিতে পারিতেন । তিনি তাহা করিলেন না ।
হায় রে মানব ! দরিদ্র যতই আপন ভাবিয়া অধিক শ্রম দিয়া থাকুক , তাহাকে লইয়া ভাবিবার অবসর যে কর্তা বাবুর নাই ; এই সরল সত্যটি উপলব্ধি করিতে চাহে না । হৃদয়ে বৃথা আশা সাজাইয়া মরে ।
অদ্য হয়তো ব্যস্ততার কারণে কর্তাবাবু বলিতে ভুলিয়া গিয়াছেন আগামী কল্য তাহার নিশ্চিত মনে পড়িবে , এই আশা লইয়া সে আপন গৃহে ফিরিল ।
জীবন মুখুজ্যের বাটীতে দুইটি বৃহৎ উনুনের উপর দুইটি কড়াই বসিয়াছে । তিনি রন্ধনশালায় বিশেষ নজর রাখিয়াছেন । কুটুম্বরা নব নব বস্ত্র পরিধান করিয়া খোশ গল্পে মজিয়াছেন । নয়ন আসিয়া উপস্থিত হইল । কর্তাবাবু তাহাকে দেখিতে পাইয়া বলিলেন , ” যা যা সকাল থেকে গরুগুলোকে এখনো খাবার দেওয়া হয়নি , দিয়ে আয় ।” সে যে পূর্বে ভাবিয়াছিল তাহার সহিত তাহার পুত্রকে না দেখিতে পাইলে , কর্তাবাবু তাহার পুত্রকে আনিতে বলিবেন ;তাহার সেই আশা নিঃশেষ হইল । সে গবাদিপশুগুলিকে খড় দিতে চলিয়া গেল ।
উৎসবের এই বিপুল আনন্দের মধ্যে একজন যে দুঃখী হইয়া রহিল তাহা কাহারো দৃষ্টিগোচর হইল না । নয়নের কোনো কার্য করিতে মন লাগিতেছিল না । সে একবার ভাবিয়াছিল এইমুহূর্তে কর্তাবাবুর সহিত সকল সম্পর্ক ঘুচাইয়া দিবে , কিন্তু পরক্ষণে আপন পুত্রের শীর্ণবদন মনে পড়িয়া যাইতেই ভাবনার বদল ঘটাইয়াছে । সে যদি এইরূপে এই বাটী হইতে চলিয়া যায় তাহা হইলে তাহার ছয় বৎসরের পুত্র অভুক্ত রহিবে ।
দরিদ্রের এমত সুযোগ লইয়া তাহাদের সহিত অমানুষিক আচরণ করা হয় । কর্তাবাবু বিরূপ করিবেন ইহা আশা করিতে পারিনা ।
সে যখন আপন গৃহ হইতে বাহির হইয়াছিল তখন তাহার পুত্র আসিতে চাহিয়াছিল , কিন্তু তাহার বধূ পুত্রকে আসিতে দেয় নাই । সে তাহাকে বিবিধ প্রকারে বুঝাইতে সক্ষম হইয়াছে যে নিমন্ত্রণ ব্যতীত কাহারো গৃহে খাইতে যাওয়া উচিত নহে । নয়ন বুঝিয়াছে , কর্তাবাবুর নিকট তাহাদের সন্মান না থাকিতে পারে কিন্তু আপন আত্মসন্মান তাহার বধূর নিকট রহিয়াছে ।
মধ্যাহ্ন হইয়াছে । নিমন্ত্রিত অতিথিবর্গ আসিতেছেন । জীবনের মনে পড়িল , ভোজনের শেষে পত্রগুলি ফেলিবার লোক দেখিতে ভুলিয়া গিয়াছেন । তিনি নয়নকে ডাকিয়া কহিলেন , ” নয়ন দেখনা খাওয়ার শেষে পাতা ফেলার লোক দেখতে ভুলে গেছি , এখন তো আর দেখাও সম্ভব নয় ; তুই যদি ……। ” নয়ন কর্তার অভিসন্ধি বুঝিল । দীর্ঘ দশ বৎসরে কখনো সে কর্তার কোনো কথার বিরূপ হয় নাই , আজিও হইল না । বলিল , ” আচ্ছা কর্তা , অমিই ফেলে দেবো ।” জীবন তাহার সম্মতি পাইয়া স্বস্তি পাইলেন ।
নিমন্ত্রিত অতিথি ভোজন সারিয়া উঠিয়া পড়িলেন । নয়ন ভোজনান্তে পড়িয়া থাকা পত্রগুলি ফেলিতে লাগিল । সে দেখিল , পত্রে বিপুল খাদ্যসামগ্রী নষ্ট হইয়াছে । শুদ্ধ বস্ত্র পরিধাণ করিয়া, স্নান করিয়া ,সে যে লক্ষ্মীকে অগ্রহায়ণ মাসে কর্তার খামারে তুলিয়াছে ; তাহার এইরূপ অপচয় দেখিয়া হৃদয় কাঁদিয়া উঠিল । সে ভাবিল, অদ্য এই বাটীতে অন্নের বিপুল অপচয় হইতেছে , অথচ তাহার পুত্র হয়ত তাহার মাতা কর্তৃক পুষ্করিণী হইতে তুলিয়া আনা কলামিশাক সেদ্ধ সহযোগে ভাত খাইতেছে । হায়রে বিধি ! দরিদ্রের অভিলাষ নীরবে জীর্ণ চালা গৃহের এককোনায় পড়িয়া ডুকরে কাঁদে । নয়নের ইচ্ছা হইল কল্য আপন গৃহে এইরূপ আয়োজন করিয়া তাহার পুত্রকে খাওয়াইবে । আনমনে বহুল ব্যবহারে বিবর্ণ জামার পকেটে হাত দিয়া দেখিল , একটি বিশ টাকার নোট পড়িয়া রহিয়াছে । তাহার অভিলাষ তৎক্ষণাৎ তথায় নিহত হইল । সমস্ত কর্ম সম্পন্ন হইয়া গেল । গৃহকর্ত্রীর খেয়াল হইল নয়ন একেলা আসিয়াছে , তাহার পুত্রটি আসে নাই । তিনি নয়নকে ডাকিয়া বলিলেন , ” বাবা নয়ন , যাবার সময় বৌ ছেলের জন্য খাবার নিয়ে যাস । ”
নয়ন বলিল , ” না মা ঠাকরুণ , ছেলের পেটের ব্যামো । এই সব খেলে তা আবার বেড়ে যাবে ।”
” ঠিক আছে ” এই বলিয়া তিনি চলিয়া গেলেন । এই স্থলে নয়ন যে ছলনার আশ্রয় লইল তাহা একমাত্র সেই জানিতে পারিল ।
উপরিউক্ত ঘটনার পর দীর্ঘ দুই বৎসর অতিবাহিত হইয়াছে । নয়ন পূর্বের ন্যয় মুখুজ্যেদের ক্ষেত বাড়ির কর্মে নিযুক্ত রহিয়াছে । পূর্ণিমার অবসান হইয়া যেরূপ অমাবস্যা অাসিত সেইরূপই আসিতেছে । নবীনের সন্তান হামাগুড়ি দিতে শিখিয়াছে । তাহার ঠাকুরদা অশ্ব সাজিয়া তাহাকে পৃষ্ঠে চড়াইয়া সমস্ত উঠানময় ঘুরিয়া থাকেন । গৃহকর্ত্রী ইহা লইয়া রসিকতা করিয়া বলেন , ” দেখো মুখে তো লাগাম নাই , বেশী জোরে দৌড়াবে না কিন্তু । ” কর্তা হো হো করিয়া হাসিয়া ওঠেন । নয়ন এনাদের হাসির সহিত হাসিয়া থাকে । এইরূপ আচরণ করিয়া সে কর্তার প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করে । এই প্রসঙ্গে একটি প্রবাদ প্রচলিত রহিয়াছে , ” তেলা মাথায় তেল দেওয়া মনুষ্য জাতির ধর্ম । ”
পূর্বেই এই বৎসরের সমস্ত পাওনাগন্ডা নয়ন বুঝিয়া লইয়াছে । তিন মাস অতিবাহিত হইলে নতুন বৎসর পড়িবে । তাহার স্ত্রী অসুস্থ হওয়াতে যেটুকু পাওনা রহিয়াছিল লইয়া লইয়াছে । আগামী তিন মাস কর্তাবাবুর নিকট হইতে কোনো টাকা পাইবার আশা নাই । সংসারের নিত্য ব্যয় চালাইবার নিমিত্তে তাহার বধূ পাড়ারই একটি গৃহস্থে এঁটো বাসন ধুইয়া কিঞ্চিত অর্থ আনিতেছে, তাহাতে মাতা ও পুত্রের ক্ষুধা নিবৃত্তি হইতেছে । এমতাবস্থায় একদিন নয়নের পুত্রের জ্বর আসিল । নয়ন বাবুদের গ্রামের হাতুড়ে ডাক্তারের নিকট হইতে ঔষধ লইয়া আসিয়াছে , কিন্তু তাহা কোনো কাজে আসে নাই । জ্বর উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাইতেছে । তাহাকে লইয়া শহরে যাইতে হইবে , শহরে সরকারী হাসপাতাল রহিয়াছে । কিন্তু শহরে যাইতে গেলে গাড়ি করিয়া লইয়া যাইতে হইবে , সে গাড়ি ভাড়া করিবার উদ্যেশ্যে তাহার জামার পকেট ও একটি পুরানো টিনের বাক্স হাতড়াইতে লাগিল । এই বাক্সটি সে বিবাহে যৌতুক হিসাবে পাইয়াছিল । জামার পকেট হইতে কিছুই পাইল না । বাক্স হইতে কয়েকটি আধুলি বাহির হইল , বর্তমানে যাহারা কোনো কর্মে লাগে না ; শুধু মাত্র পিতা তাহার সন্তানকে স্মৃতি স্বরুপ দেখাইয়া থাকেন । নয়ন হতাশ হইয়া পড়িয়াছে দেখিয়া তাহার বধূ বলিল , ” একবার কর্তা বাবুর ঘরে গিয়ে দেখো না কেনো । ” নয়ন স্ত্রীর কথামতো জীবনের গৃহের উদ্যেশ্যে বাহির হইল ।
মধ্যাহ্নের রৌদ্রে দাঁড়াইলে আপন ছায়া ইষৎ পূর্বদিকে হেলিয়া পড়িতেছে । কর্তা তাকিয়াতে হেলান দিয়া একটি ‘ শ্রী গীতা ‘ খুলিয়া পাঠ করিতেছেন । তিনি ভূমে পদ্মাসন হইয়া বসিতে পারেন না , তজ্জন্য তাকিয়াতে হেলান দিয়া একটি কম্বল পাতিয়া পাঠ করেন । তাকিয়াতে হেলান দিয়া থাকিলেও তিনি আচার হইতে বিচ্যুত হন নাই , তাহার উপর একটি খণ্ড কম্বল রাখিয়াদেন । এইরূপ মানুষকে দেখিলে যে কাহারও শ্রদ্ধা হওয়া উচিত । কিন্তু তাহার অভ্যন্তরে যে একটি শুষ্ক কঠিন হৃদয় বাস করিতেছে তাহা কে বুঝিবে ।
নয়ন আসিয়া কাচুমাচু করিয়া বলিল , ” বলছিলাম কি কর্তা ….” জীবন মোটা ফ্রেমের চশমা হইতে চাহিয়া তাহাকে থামাইয়া কহিলেন , ” কি আর বলবি , কাল তো আসিস নি , আজ যদিও আসলি তো ভর দুপুরে । তোর কামাই দিন দিন বেড়ে যাচ্ছে । এই তো কদিন আগে বৌ এর শরীর খারাপ বলে আগাম টাকা নিয়ে গিয়ে তিন দিন এলি না । ” নয়ন বিনয়ের সুরে বলিল , ” কর্তা আমার ছেলের খুব জ্বর , যদি কিছু …..” । নয়নের কথাটি শেষ হইবার পূর্বেই কর্তা ক্রুদ্ধস্বরে বলিয়া উঠিলেন , ” না না তোকে এতো টাকা আগাম দিতে পারব না । আর দিন দিন কতো বাহানা করবি , আজ বৌ এর অসুখ কাল ছেলের অসুখ । ছিঃ ছিঃ । ” নয়ন কি করিয়া কর্তাবাবুকে সত্য বুঝাইবে খুঁজিয়া না পাইয়া তাহার পা জড়াইয়া ধরিল । তাহাতে কর্তার হৃদয় গলিল না । তিনি নয়নের হস্ত হইতে নিজ পদযুগল মুক্ত করিয়া অন্যত্র চলিয়া গেলেন । নয়ন নিরুপায় হইয়া ভাবিল, যাহাদের নিমিত্তে সে দিবস রজনী এক করিয়া খাটিয়াছে, অদ্য তাহার বিপদে তাহারা মুখ ফিরাইয়া লইলেন । সে অভ্যাস বসত স্কন্ধে রাখা গামছাটি লইয়া চক্ষু মুছিল ।
বিপদে কেহ না রহিলেও একজন পার্শ্বে রহেন , তিনি ঈশ্বর । ফিরিবার পথে নয়নের সহিত জীবন মুখুজ্যের কণিষ্ঠ পুত্র তরুণের দেখা হইয়া গেল । সে এই বৎসর নিকটস্থ বিদ্যালয় হইতে দ্বাদশ শ্রেণী উত্তীর্ণ হইয়া , উচ্চশিক্ষার উদ্যেশ্যে কলিকাতার একটি নামকরা মহাবিদ্যালয়ে ভর্তি হইয়াছে । সে নয়নের চক্ষু দেখিয়া বুঝিতে পারিল ,সে ক্ষনিক পূর্বে কাঁদিতেছিল । তরুণ জানিতে চাহিল , ” কি হয়েছে কাকা , কাঁদছো কেন ? ” নয়ন আর চুপ করিয়া না থাকিয়া তাহার পুত্র যে অসুস্থ এবং সে যে তাহার পিতার নিকট টাকা চাহিতে গিয়া বিফল হইয়া ফিরিতেছে , তাহা বলিল । যে মানুষ নিজের জীবন বিপন্ন করিয়া তাহাকে বাঁচাইয়াছিল তাহার সহিত পিতা কিরূপে এই আচরন করিলেন , ইহা ভাবিয়া তরুণ লজ্জিত হইল । তাহার মনে পড়িল , ছয় বৎসর বয়সে খেলিতে গিয়া সে যখন কূপে পড়িয়া গিয়াছিল , তখন সবাই দুঃখ প্রকাশ করিয়াছিল ঠিকেই কিন্তু তাহাকে বাঁচাইতে কেহ অগ্রসর হয় নাই । একমাত্র এই ব্যক্তিটি দিকবিদিক চিন্তা না করিয়া , ঝাঁপাইয়া পড়িয়া কূপের জলে ডুবিয়া যাওয়া হইতে তাহাকে আটকাইয়াছিল । পরে সকলে দড়ি দিয়া দুইজনকে টানিয়া তুলিয়াছিল । পিতার প্রতি ক্রুদ্ধ হইয়া তরুণ বলিল , ” চলো তো কাকা দেখি । ” নয়ন তাহার পশ্চাৎ পশ্চাৎ চলিল ।
গৃহের প্রাঙ্গণে পৌঁছাইয়া তরুণ তাহার পিতার উদ্যেশ্যে চিৎকার করিয়া বলিল , ” বাবা , বাবা । ” তাহার উচ্চকণ্ঠ শুনিয়া একমাত্র নবীনের পুত্র ব্যতীত গৃহের সকল সদস্য বাহির হইয়া আসিলেন । তাহারা দেখিলেন তরুণের পশ্চাতে নত মস্তকে নয়ন দাঁড়াইয়া রহিয়াছে । কিছু বুঝিয়া উঠিবার পূর্বেই তরুণ জোরপূর্বক পিতার পৈতা হইতে সিন্দুকের চাবিটি খুলিয়া লইয়া ঘরে ঢুকিল । সে কক্ষনো পিতার অবাধ্য হয় নাই , কিন্তু আজি নিজ বিবেকের আহ্বানে জাগিয়া উঠিয়া প্রথম পিতার অবাধ্য হইল । সিন্দুক খুলিয়া পাঁচশত টাকার নোটের একটি বাণ্ডিল বাহির করিয়া লইয়া আসিল এবং তাহা নয়নের হস্তে দিয়া বলিল, ” যাও কাকা ছেলেকে ভালো ডাক্তার দেখাও । ” তরুণের এইরূপ আচরণ দেখিয়া পিতা বলিলেন , ” ওকে উচ্চশিক্ষা দিতে পাঠিয়ে আমার এই লাভ হল । ” কথাটি শুনিয়া তরুণের মাতা বলিলেন , ” নবীন তো মানুষ হয়নি কিন্তু তরুণ মানুষ হয়েছে । ” মাতার মুখ হইতে আপন নিন্দা শুনিয়া নবীনের মনে হইল , সত্যই তো সব বুঝিয়াও সে নয়নের দুঃখে সহমর্মী হইতে পারে নাই । আপন স্ত্রীর মুখ হইতে তরুণের প্রশংসা শুনিয়া ক্রুদ্ধ হইয়া জীবন বলিলেন , ” তোমার আস্কারা পেয়েই তো ও এমনি হয়েছে । ” কর্ত্রী বুঝিলেন নিষ্প্রাণ মানুষের সহিত কথা বলা অনর্থক , তথাপি বলিলেন, ” নয়ন তো আর কোথাও চলে যাচ্ছে না ,পরে না হয় কাজ করিয়ে শোধ করে নেবে ।” তাহার হৃদয়ের সহৃদয়তা এই মানুষটির কারণে মরিয়া গিয়াছে , আপন সন্তানের হৃদয়ে তাহা জাগিয়া রহিয়াছে দেখিয়া গর্বে তাহার বক্ষ পূর্ণ হইল । নয়ন উহাদের বাক্যালাপ শুনিতেছিল , সে বলিল , ” হ্যাঁ মাঠাকরুণ আমি কাজ করে শোধ করে দেবো । ” কর্ত্রী তাহার প্রতি চাহিয়া বলিলেন , ” সে কথা পরে হবে , এখন যা ছেলেকে ভালো ডাক্তার দেখা । ” নয়ন আর বাক্যব্যয় না করিয়া মাঠাকুরণের উদ্যেশ্যে করজোড়ে প্রণাম করিয়া চলিয়া যাইল । জীবন মুখুজ্যে তাহার চলিয়া যাওয়া নিষ্পলক দৃষ্টিতে দেখিতে লাগিলেন , তাহার মনে হইল নয়ন নহে তাহার সঞ্চিত অর্থ হাঁটিয়া যাইতেছে ।
নয়ন যখন গৃহে আসিয়া পৌঁছাইল , দেখিল তাহার বধূ পুত্রকে ক্রোড়ে লইয়া , স্তব্ধ হইয়া বারান্দায় বসিয়া রহিয়াছে ।