মতিহারা পাহারাওয়ালা।
যুথিকা দাস।
গেরামটা পাহাড়ী!পাশেই শহর। পাহাড়ের ঘা ঘেসে একটা পথ। এক সরকারি দায়িত্ব নিয়ে ঐ গ্রামে এসছেন এক পুলিশ অফিসার। একদিন রাতে একজন লোকের সাথে দেখা হল। সবাই ওকে পাগল বলে, তবে পুলিশের সাথে লোকটার খুব ভাব জমেছিল , সন্ধ্যায় চা আর সিগারেট খেতে খেতে অনেক গল্প স্বল্প হত , কিছু তথ্য সংগ্রহ ইত্যাদি চলত পুলিশের এ ভাড়াটে ঘরে। কিছু রাত হলেই বেরিয়ে পড়ত লোকটা! কদিন পর পর গ্রামে আসত কোথা থেকে কেউ জানেনা, কদিন উদাও হয়ে য়েত। প্রায়ই নদীটার গভীর জলে লোকটা কি খোঁজত কেউ জানেনা, এর উত্তর ।
কাজলা নদী বেয়ে শহরে এসে মিশেছে একটা পথ , গ্রামটায় অনেক গরীব তাঁতী, মুচি, কামার, খেওয়ানীদের বসতি। এখানেই হারু খেওয়ানীর বাড়ি। হারুর বাপ কাজলা নদীতে খেওয়া দিত। প্রবল বৃষ্টিতে ভিজত, কিংবা রোদ মাথায় নিয়ে খেওয়া দিত। অনেক বয়স করে বিয়ে হয়েছিল। লোকটা ছিল বেঁটে, তাই বিয়ের বয়সে আর বিয়ে হয়নি, শেষ বয়সে বিয়ে করে হারুকে পেয়েছিল। এক দুবছর যেতে না যেতেই অভাব আর অসুখে পড়ে মৃত্যু হয় তার । তবে গ্রামটার অতীত কি ছিল প্রায় লোকজন ভুলেই গিয়েছিল অভাবের তাড়নায় যদিও আজ সবাই সচ্ছল !
শহরটা খুব ছিমছাম। কেনো জানি রাত হলেই পাহাড়ের গা ঘেসে একটা আওয়াজ এসে শহরের নিস্তব্দতা ভেদ করে আকাশে ভাসতে থাকে।
“মতিহার পাহারাওয়ালা, চুপ যাও, পিছিয়ে য়াও! মতিহার পাহারাওয়ালা। ”
রাতের অন্ধকার ভেদ করে আর্তস্বর সব আকাশ ছিন্ন করে দিত। অজানা আতঙ্ক মানুষকে তাড়া করত কদিন পর পর।
একদিন প্রসঙ্গক্রমে পুলিশবাবু পাগলটাকে তার নাম জিজ্ঞেস করলেন। উত্তরে লোকটা বলল কি করবেন নাম জেনে, আমাকে সবাই পাগল বলে ডাকে, মানুষ কখনও উপহাস করে, কখনও ঢিলও ছু্ঁড়ে।
নামটা যাই হোক কামটাই আসলে কি জানেন? পুলিশ বাবু!
বাপ দাদা চৌদ্দ পুরুষের পদবী খেওয়ানী। আমিও আর বাদ যাব কেন! বাপটা কম বয়সেই বেঘোর জ্বরে প্রাণ হারায়, জোয়ান মা, বাপমরা ছেলেটাকে বড় করতে অনেক ভদ্দর মানুষের বাড়িতে গতর কাটিয়ে অনেক খড়কুটো পুড়িয়ে আমি ছেলেটার গলে একটা সুন্দর মতিহার ঝুলিয়ে দিয়ে পরলোক যাই যাই করছিল। আমি বৌ ও মা কে নিয়ে কোনোমতে একটা ছোট দোকানের উপর ভরসা করে দিনটা কাটাতে লাগলাম। সবাই বলবেন বাপদাদা যখন খেওয়ানী, আমি কেন নয়? ওহো! সে পথ বেছে নিতে পারলাম না, কারণ আমার বাপ মরার সময় বারণ করে মরেছিল, ছেলেটাকে নিয়ে শহরে পাড়ী না দিয়ে গেরামেই থাকতে আর খেওয়ার কাজটা যেন না করি। দৈন্যতার চাপে পড়াশোনা করতে আর পারিনি পুলিশবাবু, কোনোমতে নাম লেখা এই মাত্র।
পিতৃসত্য! তাই বৌ মাকে নিয়ে কোনোমতে চলে, দোকানের পর রাতে আবার ঐ গেরামে পাহারা দিয়ে রোজগার যা হত, কোনোমতে সংসার চলত। বছর দুয়েক যেতে না যেতেই আমার ঘরে লক্ষ্মী এলেন, মা ও একটু সুস্থ হয়ে উঠল। আমার দোকানটাই এখন সারা গেরামের একমাত্র সম্বল ছিল। রাতে সবার ঘর পাহারা দিয়ে যা জুটে তা দিয়েই চলত ভাল এই আমার ছোট্ট গেরামে।
একদিন প্রবল বৃষ্টিতে অকালে বাঁধ ভেঙ্গে জল ঢোকে পড়ে গেরামে, আমি ছিলাম হাটে দোকানের জিনিষ খরিদ করতে গিয়েছিলাম। প্রচণ্ড বৃষ্টিপাতে জল স্ফিতি হতে লাগল, কয়েক ঘণ্টার বৃষ্টিপাতে আমার সব ছারখার করে দিল। ছারখার করে দিল আমার এ সহজ জীবনটাও পুলিশবাবু! মা বেটি বৌ সবাইকে জলের তোড়ে ভাসিয়ে নিয়ে গেল।
সেই থেকেই আমাকে সবাই পাগল বলে, পথ ঘাটে ঘুরতে থাকি, তবে আমি পাগল নই! দোকানটা নেই, বাড়িটায় জঙ্গল লেগে আছে, মা, বৌ ও বেটিকে আর শেষ দেখা পাইনি। এখন আমি খেওয়ানী নই, তবু আমার নাম মতিহারা খেওয়ানী। পুলিশ বাবু আমার নামটা লিখবেন, মতিহারা খেওয়ানী!গেরামে আর রাতের হাঁক দিই না, যেখানেই যাই সেখানেই মতিহার হাঁক পাড়ি! আজ নিয়ে যান আপনার থানায়, থানাতেই হাঁক দেব, কেউ আমার মতো পারবেনা, পুলিশবাবু আমার মতো কেউ পারবেও না হাঁক দিতে ” মতিহারা পাহারা ওয়ালা”!
তারপর ওর চোখের কোণ বেয়ে একফোঁটা জল মাটিতে গড়িয়ে পড়ল, ঠিক মূল্যবান মতির মতো লাগল দেখতে রাতের হাল্কা আলোতে।
প্রতিদিন তো পারিনা, মাঝে মাঝে আমার বৌ আর বেটিকে দেখতে এ কাজলার জলে ডুব দিয়ে খুঁজি আমার বৌ মতিহারা কে , ওরা যদি একবার আসে ফিরে এই আশায়! মায়ের জন্য হাঁক পাড়ি, এ আকাশের তলে, ঐ যে পাহাড়টা দেখছেন, এ পাহাড়েই গভীর অরণ্যে আমার মা ও লুকিয়ে আছে, যদি কোনোদিন আমাকে হারু! ও হারু! বলে ডাকে, এ ভরসায় পুলিশ বাবু।
আপনিই বলুন পুলিশবাবু, আমি হারু, না মতিহারা খেওয়ানী?
###################
রচনা কাল
০৪/০৮/১৭