গবেষণামূলক প্রবন্ধ প্রবন্ধ

শামসুর রাহমানের স্বপ্নশাসিত কবিতা

শামসুর রাহমানের স্বপ্নশাসিত কবিতা

ড.এস এ মুতাকাব্বির মাসুদ


কবি শামসুর রাহমান সম্পর্কে বলা হয়
পঞ্চাশের দশকে আধুনিক বাংলা কবিতা চর্চার পর্বে তিনি ছিলেন একজন নিরীক্ষা
ধর্মী লেখক। কবিতার দী দীক্ষা তাঁর প্রাগ্রসর মনের চারণভূমিকে যে মাত্রায়
কর্ষণ করেছিলো সেখানে নিত্যসত্যের
উৎসারণ তাঁর কবিসত্তার চূড়ান্ত উৎকর্ষের
একটি দিক।এ যাত্রায় তাঁর কবিকর্মের
শৈল্পিক বীক্ষণ অনুপুঙ্খ এক জাগ্রত
আধুনিক বিনম্র কবিমনের শিল্পচেতনার
অতলান্তিক ব্যঞ্জনা নতুন সিরে উদ্ভাসিত।
এ পর্বে কাব্যধারার নতুন এক শৈল্পিক
বিভা শামসুর রাহমানের হাত থেকে বিরামহীন দক্ষতায় ওঠে আসে আমাদের কবিতার অঙনে।ঋদ্ধতায় পরিব্যাপ্ত হয়
তাঁর কবিতার দীপ্তিময় জগৎ এক উদ্ভাসিত আলোকে।শামসুর রাহমান হয়ে ওঠেন
বাংলা কবিতার অবিসংবাদিত একচ্ছত্র
অধীশ্বর।

প্রসঙ্গ যেহেতু তাঁর স্বপ্নশাসিত কবিতা,
সুতরাং স্বপ্ন অনুশাসিত কবিতা কল্পনা ও
বাস্তবতার সংমিশ্রণে কবিতার মৌলিক
উৎকর্ষকে শৈল্পিক বিভায় আলোকিত করে তুলে। শামসুর রাহমানের কবিতায় এ স্বপ্নের বহুমাত্রিক ব্যবহার লক্ষ করা যায়।
এ ‘স্বপ্ন’ প্রতীকী হিসেবে যেমন ওঠে এসেছে, তেমনি নানাসময় নানাভাবে কাব্যরীতির প্রধান অনুষঙ্গ হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে।কবিতার ক্ষেত্রে উপমায়,
উৎপ্রেক্ষায়, চিত্রকল্প,রূপকল্প,ইত্যাদির ভাবধারায় জীবন-মৃত্যু এবং আলো আলো-আঁধারের মাঝখানে ‘স্বপ্ন’ ব্যবহৃত হয়ে কবিতার অন্তর্নিহিত ভাবসত্যের ব্যাপকতাকে বৃদ্ধি করেছে শৈল্পিক চেতনায় এবং জীবনবাস্তবতার আলোকে। শামসুর রাহমানের লবিতায় স্বপ্নের ব্যবহার জীবনসত্যের অন্যতম অনুষঙ্গ হিসেবে প্রতীকী উপস্থাপনে বিশ্লেষিত হয়েছে। এ ধারায় শামসুর রাহমানের কবিতায় ‘স্বপ্ন’ প্রসঙ্গ এবং তাঁর স্বপ্নশাসিত কবিতার সংক্ষেপিত আলোচনার প্রাসঙ্গিক উপস্থাপন করা গেলো।

বাংলা কবিতায় আধুনিকতার উন্মেষ ঘটে ১৯১৪-১৯৩৯এর মাঝখানে ২৫ বছরের সময়ের মধ্যে।এর ভেতর আমরা দু’টো বিশ্বযুদ্ধ প্রত্যক্ষ করি।প্রথম এবং দ্বিতীয়। এ কঠিন সময়ের মধ্যে সাহিত্যের
প্রেক্ষাপট পরিবর্তনের বিষয়টি ছিল স্বাভাবিক।কবিতায় তা ওঠে এসেছে বাস্তবতার আলোকে।কবিতায় বস্তুনিরপেক্ষতার বিচারে স্বপ্ন-কল্পনার বিমূর্ত প্রতিবেদন চিত্রিত হয়েছে নিরঙ্কুশ জীবনবাস্তবতার অতুলস্পর্শে।শিল্পীর মেধাবী তুলিতে নতুন জীবনের স্পর্শ বিম্বিত হয়েছে কবিতার নিপুণ পঙক্তিতে। এ ধারায় আধুনিকতার শিল্পোৎকর্ষের ব্যাপক উপস্থাপনে অসাধাররণ শিল্পরূপের পরাকাষ্ঠা লক্ষ করা গেছে বুদ্ধদেব বসুর(১৯০৮-১৯৭৪) ‘বন্দীর বন্দনা'(১৯৩০)
বিষ্ণু দের(১৯০৯-১৯৮২)’উর্বশী ও আর্টেসিস'(১৯৩৩),সুধীন দত্তের(১৯০১-১৯৬০)’অর্কেস্ট্রা'(১৯৩৫),
জীবনানন্দ দাশের ‘ধূসর পাণ্ডুলিপি ‘(১৯৩৬),অমিয় চক্রবর্তীর(১৯০১-১৯৮৬)
‘ খসড়া ‘(১৯৩২) প্রভৃতি কাব্যগ্রন্থে।উল্লেখ্য
শার্ল বোদলেয়ার(১৮২১-১৮৬৭) তাঁর “Les Fleurs du Mal “(1857)কাব্যগ্রন্থে আধুনিক কবিতার নীরিক্ষিত এবং মৌলিক উৎকর্ষের প্রাথমিক সূচনার প্রয়াস পেয়েছিলেন। এ ধারায় কবিতায় আধুনিকতার বীক্ষিত রূপটির প্রাথমিক উৎসর্জন এবং শিল্পিত রূপের নান্দনিক বীজটি প্রথম উপ্ত হয়েছিল বলে মনে করা হয়।

তিরিশের আধুনিক কবি জীবনানন্দ দাশ,সঙ্গ-নিসঙ্গতার কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর(১৮৬১-১৯৪১),এবং কুশলী কবি সুধীন দত্ত(১৯০১-১৯৬০)। তিরিশ উত্তর জীবনবাস্তবতায় নগরসভ্যতার যে ছবি
শামসুর রাহমান কবিতার জমিনে নিপুণ
হাতে শৈল্পিক বুনটে বিন্যস্ত করেছেন, তাতে
তাঁর নাগরিক কবিসত্তার উদ্ভাস লক্ষ করি।
বস্তুনিরপেক্ষতার আলোকে তাঁর কবিতায়
উৎসর্জিত হয়েছে বহির্জগৎ এবং প্রতিবেশ
বাস্তবতা।প্রতিবেশের সামগ্রিক সদাচারকে
অশেষ নিষ্ঠতায় এবং নিজস্বতায় অন্তর্লোকে ধারণ করে আধুনিক বাংলা কবিতার অবিরোধী সৌধ নির্মাণ করেছেন শামসুর রাহমান। এভাবেই তাঁর কবিতায় দ্যুতিত হয়েছে সমকালীন জীবন সৃষ্টির বীক্ষিত চলচ্চিত্র।

বস্তুত মধ্যযুগ থেকে আধুনিক যুগ পর্যন্ত সকল কবির কবিতায় ‘স্বপ্ন’ প্রসঙ্গ
বিদ্যমান সত্য।এ ধারায় বিহারীলাল চক্রবর্তী (১৮৩৫-১৮৯৪),রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৬১-১৯৪১),কাজী নজরুল ইসলাম(১৮৯৯-১৯৭৬),জীবনানন্দ দাশ(১৮৯৯-১৯৫৪),সুধীন দত্ত(১৯০১-১৯৬০),অমীয় চক্রবর্তী (১৯০১-১৯৮৬),অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত(১৯০৩-১৯৭৬),বুদ্ধদেব বসু(১৯০৮-১৯৭৪),সোপেনহ্যার(১৭৮৮-১৮৬০),কিটস্(১৭৯৫-১৮২১),এজরা পাউন্ড (১৮৬৫-১৯৭২),জেমস জয়েস(১৮৮২-১৯৪১),টি এস এলিয়ট(১৮৮৮-১৯৬৫) প্রমুখ কবিদের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

শামসুর রাহমানের কাব্যচেতনায় এলিওয়টের মতো অস্তিত্ববাদের দৃশ্যমান চিত্র ওঠে এসেছে, আবার কখনো এ ‘স্বপ্ন’
অস্তিত্ববাদের বিষয়টিকে বিশ্লেষণে সহায়তা করেছে। টি এস এলিয়টের কবিতায় অস্তিত্ববাদের চিত্র স্পষ্ট হয়ে ওঠেছে। এলিয়টের উচ্চারণ :
“… Our only health is disease…
And that to be restored,
our sickness must grow worse “…
(Four Quarters)
শামসুর রাহমানের কবিতায় ‘ স্বপ্ন ‘ এসেছে মানুষের সুখ-দুঃখ,আশা-নিরাশা, ব্যথা-বেদনা,আনন্দ-উল্লাসের প্রতীকী ব্যঞ্জনায় ব্যবহৃত হশেছে বারবার প্রতিবেশের মূল্যায়নে, জীবনবাস্তবতার বৈচিত্রময় দৃশ্য পরম্পরায় কবিতার অন্তর্লোকে অস্তিত্ববাদের চেতনাকেও নিশ্চিত করেছে।
বস্তুত “স্বপ্ন” প্রসঙ্গ অনেকটা Cryptic । শামসুর রাহমানের
কবিতাসমগ্র ১, দ্বিতীয় মুদ্রণ, ২০০৮ এ সন্নিবিষ্ট ও সংস্থাপিত ১৬টি কাব্যগ্রন্থে ৬০৬টি কবিতা সন্নিবদ্ধ রয়েছে।তাঁর প্রত্যেকটি কাব্যগ্রন্থে “স্বপ্নের” বহুমাত্রিক ব্যবহার লক্ষ করা যায়।”প্রথম গান দ্বিতীয় মৃত্যুর আগে”(১৯৬০) শীর্ষক কাব্যগ্রন্থে ৩৯টি কবিতার মধ্যে “স্বপ্ন “ব্যবহৃত হয়েছে ২৩ বার। এ ধারায়”দুঃসময়ের মুখোমুখি”(১৯৭৩)র ৩৯টি কবিতায় ১১, “একধরনের অহংকার”(১৯৭৫)এ ৫২ টি কবিতায় ২৮, “বিধ্বস্ত নীলিমা”(১৯৬৭)য়
৪৬ টি কবিতায় ৪১,”রৌদ্র করোটি”তে(১৯৬৩),৪৫ টি কবিতায় ৪১,” নিজ বাসভূমে “(১৯৭০),৫৮ টির মধ্যে ১৭, “বন্দীশিবির থেকে”(১৯৭২),৩৮ টি কবিতার মধ্যে ২টি, “শূন্যতায় তুমি শোকসভা”তে(১৯৭৭) ৪১ টির মধ্যে ৫০,”বাংলাদেশ স্বপ্ন দ্যাখে”(১৯৭৭), ৪৬টির মধ্যে ৮২ টি,”ইকারুসের আকাশ”(১৯৮২), ১৯ টির মধ্যে ৩০, “কবিতার সঙ্গে গেরস্থালী”(১৯৮৩)-৩৯টির মধ্যে ২৭,”আমার কোন তাড়া নেই”(১৯৮৪)-২৩টির মধ্যে ১৫,”হোমারের স্বপ্নময় হাত”(১৯৮৫)-২৬ টির মধ্যে ৩২,”ধূলায় গড়ায় শিরস্ত্রাণ “(১৯৮৫)-৩৬টিতে পাই ২৩, এবং “আমরা ক’জন সঙ্গী”(১৯৮৬), সর্বশেষ ১৬ সংখ্যক কাব্যগ্রন্থের ৩৬ টি কবিতায় “স্বপ্ন” ব্যবহৃত হয় মাত্র ৮ বার।শামসর রাহমসনের ১৬টি কাব্যগ্রন্থের ৬০৬ টি কবিতায় “স্বপ্ন”প্রসঙ্গ কিংবা “স্বপ্নের ” প্রায়োগিক ব্যবহার উপস্থাপিত হয়েছে কম-বেশি ৪৬১ বার।

শামসুর রাহমানের কবিতায় স্বপ্ন ও কল্পনার সংস্থিতি নতুন শিল্পচিত্রেরই
Synthesis বিজ্ঞাপিত করেছে। কবিতায় অদৃশ্যমান “স্বপ্ন”কে জীবনবাস্তবতায় তুলে এনে সমাজ,মানুষ,সময়,প্রতিবেশের ক্ষয়িষ্ণু নগর জীবনের আসন্ন ব্যঞ্জনা প্রতীকী উদ্বোধকের আলোকে উদ্ভাসিত করেছেন। তিনি ক্রমাগত স্বপ্নকে প্রশ্রয় দিয়েছেন। সকল স্বপ্নের মধ্যে নগর সভ্যতার স্বপ্ন ও আলোকিত মানুষের স্বপ্ন কবির অন্তর্গত মানবিক মূল্যবোধের মৌলিক কবিসত্তার স্বাতন্ত্র্য ধারাকে প্রকাশ করে।এখানে কবি এক স্বাতন্ত্র্য বৈশিষ্ট্যের নিজস্বতাকে কবিতার ভেতর স্বপ্ন ও কল্পনার মাধ্যমে জীবনের অন্যরূপকে উপগত করতে পেরেছেন।এসকল “স্বপ্ন” কবিতায় বিজ্ঞাপিত হয়েছে তাঁর কাব্যচেতনার প্রণত আদর্শিক অভিযোজন (Adaptation) হিসেবে।

শামসুর রাহমান “স্বপ্ন” দেখেছেন, স্বপ্নকে শিল্পের অনন্য উচ্চতায় অধিষ্ঠাপন করে অনুদ্ধত ভঙ্গিতে জীবনকে খোঁজেছেন একটি আদর্শের ভেতর। এ ধারয় “স্বপ্ন”কে সাথি করে এ অভিক কবি নিজেকে উপস্থাপন করেছেন অস্তিত্ববাদের অনুগামী ধারায় সূক্ষ্ম প্রয়োগের মাধ্যমে যা এলিয়টের কবিতায়ও স্বচ্ছতার সাথে উপস্থাপিত হয়েছে।শামসুর রাহমানের আন্তঃসাহিত্যের প্রতীতি অনুপুঙ্খ চর্চায় যে মৌলিক ভিত্তি ও প্রারম্ভিক উদ্দিপনতা তাঁর কবিতায় সার্বিক দ্যুতিময়তায় প্রযুক্ত হয়েছে।

বৈশ্বিক অনুপ্রাণগত উপলব্ধির ধারায় তাঁর কবিতায় বিনম্র এবং অনুদ্বিগ্ন উপস্থাপন ভৌগলিক সীমাকে অত্যুজ্জ্বলভাবে অতিক্রমেরর প্রয়াস,”স্বপ্ন” কাব্যকলার শিল্পোৎসর্জন,প্রেম-পরিণয় ও নারীর শাশ্বত সত্তার চিরাভ্যস্ত মানবিক উদ্ভাসন,জীবনবাস্তবতায় সুব্যক্ত করে তুলেছেন।

বস্তুত নির্জনতার কবি শামসুর রাহমান। নিরন্তর স্বপ্ন দেখেছেন। কবি অনন্তকাল স্বপ্ন শূন্যতায় থাকতে চান নি।বর্ণিক কবি জীবনকে অনুসন্ধান করেছেন স্বপ্নের ভেতর। তাই স্বপ্নকেই আলিঙ্গন করতে চেয়েছেন বারবার। কবির স্বপ্নের প্রতি যৌক্তিক দুর্বলতা স্বাভাবিক। কবও যেন তাঁর আত্মার প্রতিকৃতির প্রচ্ছায়াকে স্বপ্নের উপযোগীতায় জীবনবাস্তবতার স্বচ্ছ ক্যানভাসে উপস্থাপন করে কবিতার শৈল্পিক উৎকর্ষের বিভঙ্গকে বিভাবিত করেছেন। এ প্রসঙ্গে কবির নিজেরই উচ্চারণ :
“বলে এ জীবন ভাঙা হাঁটু গেড়ে
বসে গৃহকোণে আর মাথা রাখে
স্বপ্নহীন ক্ষুধিত দেয়ালে”
(কমা সেমিকোলনের ভিড়ে)

বোদলেয়ারের(১৮২১-১৮৬৭) কবিতায় স্বপ্ন এসেছে জীবনের বিমূর্ত ছবিকে মূর্ত করে, কখনো বেদনার নির্যাস নিয়ে,কখনোবা বিপন্ন মানবতার দুঃখময় স্মৃতির বৈচিত্র্যময় স্বাতন্ত্র্যকে মেলে ধরতে।এ ধারায় তাঁর উচ্চারণ :
“Your feet are as slender as your hands, and your hips…
White women with envy…
…Where you floating dreams are full of hummming birds and always.
Like yourself, full of grace”
(To a Malabar Woman)
অনুবাদ -বুদ্ধদেব বসু
” তোমারই হাতের মতো সুককুমার তোমার পা দু’টি,জঘনে জাগাও ঈর্ষা ব্যক্ত করে
শ্বেতাঙ্গীরর ত্রুটি;…
দাও গা এলিয়ে স্নেহে বারান্দার নরম মাদুরে; পাখির কূজনে পূর্ণ তোমার স্বপ্নেরা ভাসমান এবং পুস্পল রূপে নিরন্তর
তোমারই সমান।”
(কোন মালাবারের মেয়েকে)

এরই ধারাবাহিকতায় আমরা এলিয়টের কবিতার বিভঙ্গ বিশ্লেষণে লক্ষ করি,তাঁর জীবন-যন্ত্রণা সৃজনশীল মনীষীতার উপর প্রত্যক্ষ প্রভাব ফেলেছিল।যে বৃত্ত ভেঙ্গে ফেলার ইচ্ছে থেকে যন্ত্রণাকাতর এলিয়ট জীবনবস্তবতায় কম্পিত অনুধানে খোঁজেছেন জীবনকে,জীবনের মোলিক সতকে।”The Hollow Men”শীর্ষক কবিতায় ওঠে এসেছে জীবনের অসুন্দর চিত্রপট।নিরাশায় বিপর্যস্ত কবি আলোর সন্ধানে বিপন্ন এবং হতাশায় মুহ্যমান,তবুও খোঁজেছেন জীবনসত্যকে,যেখানে বোদলেয়ার,শামসুর রাহমান একই ধারায় অসুন্দরের ভেতর সুন্দরকে অন্বেষণ করেছেন।তাঁর এ কবিতায় Super Natural প্রসঙ্গকে প্রতীকী চেতনায় উপস্থাপনের পাশাপাশি তাঁর সৃবপ্নের অদৃশ্যমান সৌন্দর্যের পরিবর্তনে কোন প্ররভাবই কার্যকর নয়।যেখানে সৌন্দর্যের পরিবর্তন হওয়া সম্ভব,সে অবস্থান এখন
অতিক্রান্ত। কেননা সে পৃথিবীতে চলমান বাস্তবতায় জীবন্ত মনুষের বসবাস।

যে স্বপ্ন এলিয়ট কলল্পনায় নিয়ে এসে মূর্ত করে উচ্চারণ করেছেন :
“Eyes I dare not meet in dreams
In death’s dream kingdom
These do not appear;
There, the eyes are…”
(The Hollow Men-1925)

কবিতায় উপস্থাপিত স্বপ্নের দৃশ্যমান পৃথিবী অনেকটাই Occult nameless, বা”Death’s dream kingdom”.
এলিয়টের অস্তিত্ববাদের আড়ালেই নিহিলিস্টিক চেতনার সর্বাত্মক অভিজ্ঞান এ কবিতায় অভিযোজিত হয়েছে। এখানে কবি অনেক সত্য অন্বেষণ করেছেন,হয়তো পেয়েছেন,হয়তো এখানে কিছুই ছিলনা।কিছুই নেই।”The Hollow Men”কে প্রখ্যাত সমালোচকরা গ্রহণ করেছন”Marks the dead centre in Eliots Poetry”হিসেবে।

“বিধ্বস্ত নীলিমায়(১৯৬৭) ব্যবহৃত “স্বপ্ন” কবির স্বপনচারী সত্তার উন্মেষ, কবির অজস্র কবিতায় এর বহুমাত্রিক উপস্থাপন,বস্তুত কবিতার আঙ্গিক সৌন্দর্যের শৈল্পিক মূল্যবোধ এবং সাহিত্যিক মূল্যের বিভঙ্গ বিশ্লেষণে শামসুর রাহমানের আধুনিক জীবনমস্কতাকে অন্য উচ্চতায় পৌঁছে দিয়েছে।ঋষি কবি জীবন আর স্বপ্নের মাঝে যে সমন্বয় তৈরি করেছেন, সেখানে স্বপ্নের ভেতর জীবনের অন্যরূপ খোঁজার পাশাপাশি স্বপ্নহীন মানুষ জীবনকে জয় করতো পারে না এ প্রেক্ষিত বিবেচনায় নিয়ে স্বপ্নের সাথে জীবনের তাত্ত্বিক সম্পর্কের তাৎপর্যকে দারর্শনিক চেতনায় স্পষ্টীত করে তুলেছেন।স্বপ্নকে তিনি নান্দনিকতায় নিরন্তর অন্তরে লালন কররেছেন।”তার স্বপ্নকল্পনাবোধ উজ্জ্বল “। এ স্বপ্নভঙ্গের অভিমানও কবির নিঃসঙ্গতায় শৈল্পিক বৈভবকে দ্যুতওত কররেছে নিঃসন্দেহে।তাঁর কবিতায় বাস্তব সত্যের বিজ্ঞাপিত যৌক্তিক ব্যবহার জীবনঘনিষ্ঠতায় ওঠে আসলেও স্ববপ্নই যেন শামসুর রাহমানের শৈল্পিক চেতনার প্ররিয় অনুষঙ্গ। কবির কোমল উচ্চারণে সে সুর অনুরণিত হতে দেখা যায়:
“দেখি প্রত্যহ দুঃখের তটে
ভাসে স্বপ্নের রূপালি নৌবহর…
কী করে বাঁচাই স্বপ্নের মায়াতরী ?”
(শুধু একটি ভাবনা)
“স্বপ্নহীনতায় সকাল হলো ধূ ধূ
স্বস্তি নেই খাটো মাঠের মুক্তিতে।…
তিনটি সাদা ঘোড়া স্বপ্ন তিনজন।”
(তিনটি ঘোড়া)
বস্তুত কবি শামসুর রাহমান স্বপ্নহীনতায়
বাঁচতে চাননি।
————-

——————————–
২৩-১০-২০১৭

Related Posts